অনাথ ৬ বন্ধুর এসএসসি জয়

সবারই স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়া

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  পঞ্চগড় প্রতিনিধি

ছোটকালেই তারা বাবাকে হারিয়েছেন। অভাবের তাড়না আর নানা প্রতিবন্ধকতায় থাকা হয়নি মায়ের কাছেও। কখনো নিকটতম স্বজনের স্নেহের পরশ পাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি তাদের। নেই প্রতিবেশী, নেই পরিচিত কেউ। ঠিকানাহীন এমন ছয় বালক এবার এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন পেয়েছেন জিপিএ-৫। সবার স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দুঃখিনী মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার। অনিশ্চিত পথের জীবন থেকে ওঠে আসা এই ছয় বালক একে অপরের বন্ধু। তারা হলেন- শ্রী সাগর টপ্পো, বিপ্লব বাবু, আব্দুল মজিদ, সাজ্জাদুল ইসলাম সিয়াম, আরিফুল ইসলাম জয় এবং সাগর চন্দ্র রায়। ছোট থেকে তারা বেড়ে উঠেছেন পঞ্চগড়ের আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে। এ বছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তারা। এসএসসির সফলতায় তাদের যেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, চোখে নতুন জীবন সাজানোর স্বপ্ন। তাদের মতো স্বপ্ন বুনছেন নগরীতে থাকা আরো ১৬০ জন মা-বাবাহীন শিশু। আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরীটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমূল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। গত রোববার বিকালে এই শিশু নগরীতে গিয়ে দেখা যায়, দুই পাশে দুটি বড় বড় ভবন। মাঝে একটি বিশালাকার খেলার মাঠ। শিশুদের পদচারণায় মুখর মাঠটি। সেখানে কথা হয় সদ্য এসএসসি পাস করা এই ছয়জনের সঙ্গে। জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন সাগর টপ্পো। রংপুরের মিঠাপুকুরে তাদের বাড়ি ছিল। ২০১২ সালে তার দিনমজুর বাবা সামছুল টপ্পো মারা যান। এরপর থেকেই ছোট্ট সাগর মায়ের সঙ্গে জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, শুরু হয় ভাসমান জীবনযাপন। থাকতে হতো খেয়ে না খেয়ে। পড়ালেখা তো ছিল কল্পনাতীত। সেখান থেকে এক সমাজকর্মী উদ্ধার করে ২০১৪ সালে এই শিশু নগরীতে ঠাঁই দেন সাগরকে। এরপর থেকে শুরু হয় তার নতুন স্বপ্ন দেখা। প্রাথমিকেও ভালো ফলাফল ছিল তার। প্রকৌশলী হতে চান সাগর, দেশের জন্য কিছু করতে চান তিনি। জিপিএ-৪.৫৪ পাওয়া বিপ্লব বাবু জানান, বাবা-মায়ের সঙ্গে রংপুরে থাকতেন তিনি। বাবা এরশাদ আলীর মৃত্যুর পর খুব কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো তাদের। ২০১৩ সালে এক দুঃসম্পর্কের স্বজনের মাধ্যমে এখানে আসেন তিনি। বলেন, শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও এখন ভালো আছি। এটাই আমার বড় ঠিকানা। এসএসসি পাস করব, এটা ছিল স্বপ্নের মতো। পাস করেছি, এই অনুভূতি বুঝাতে পারব না। পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করতে চাই। জিপিএ-৪.৫৪ পেয়েছেন আব্দুল মজিদও। তিনি বলেন, আমার জন্মস্থান দিনাজপুরে। ২০০৯ সালে আমার বাবা নিরুদ্দেশ হন। বেঁচে আছেন কি না জানি না, মা ঢাকায় থাকেন। আমিও ঢাকায় একটি অনাথআলয়ে ছিলাম। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এরপর ঠাঁই হয় এখানে। এখানে থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই পাশের বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই এবং এ বছর এসএসসি পাস করি। ভালো রেজাল্ট করেছি, সামনে আরো ভালো করতে চাই। সাজ্জাদুল ইসলামের সিয়ামের রেজাল্ট জিপিএ-৪.৩২। তিনিও বাবা হারিয়েছেন অবুঝ কালে, থাকা হয়নি মায়ের কাছেও। তিনি বলেন, কখনো কারো আদর-স্নেহ পাইনি। আত্মীয়স্বজন কেউ আছেন কি না, তাও জানি না। এই শিশু নগরীই আমাদের ঠিকানা। এখানকার স্যারেরাই আমাদের অভিভাবক। জিপিএ-৩.৮২ পেয়ে উত্তীর্ণ আরিফুল ইসলাম জয় বলেন, ঢাকায় থাকতাম। বাবার মৃত্যুর পর এখানে ঠাঁই হয়, মা ঢাকায় গৃহকর্ত্রীর কাজ করে। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়। আমাদের বাড়ি কই জানি না, মায়ের কাছে কখনো জানতেও চাইনি। জিপিএ-৩.৭১ পাওয়া সাগর চন্দ্র রায় কখনই বাবাকে দেখেননি। তার জন্মের পর পরই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন বাবা শলন্ত রায়। বেঁচে আছেন কি না, তাও জানেন না। শুধু জানেন তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে, মায়ের নাম কুসু রানী। আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরী কর্তৃপক্ষ জানায়, বিভিন্ন বয়সি ১৬০ শিশু রয়েছে এখানে।