পালিত হলো মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বানিয়াচং (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি

১৮ আগস্ট মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে এই দিনে পাক হানাদাররা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় শতাধিক নারী-পুরুষকে হত্যা করে। নরপশুদের ভয়াল থাবা থেকে বাদ যায়নি কোমলমতি শিশুটিও। দিবসটিকে ঘিরে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। তবে স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও যেমনি করে এ শহীদদের দেওয়া হয়নি মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা ও তাদের পরিবারকে দেওয়া হয়নি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বীকৃতি তেমনি করা হয়নি অবকাঠামো উন্নয়ন, দেওয়া হয়নি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। সৈয়দ ফজলুল হক মোতাওয়াল্লীর নেতৃত্বে বানিয়াচংয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে উঠে ১৯৭১ সালে। ঘৃণ্য ও জঘন্যতম দেশদ্রোহী স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে ১৫ আগস্ট পাকহানাদার সেনা কর্মকর্তারা বৈঠক করে বানিয়াচং মাকালকান্দি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট বুধবার ভোরে অর্ধশতাধিক নৌকা নিয়ে রওয়ানা দেয় হানাদার বাহিনী। বানিয়াচং থেকে স্থানীয় রাজাকাররা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আনুমানিক সকাল ৮ ঘটিকায় ঘাতকরা পৌঁছায় দুর্গম ও তৎকালীন ধনসম্পদ ভরপুর মাকাল কান্দি গ্রামে। তখন গ্রামবাসী চন্ডি মন্দিরে মনষা পূজা করছিলেন। কোনো কিছু বুঝার আগেই পূজায় মগ্ন নিরীহ নরনারীদের উপর ঝাপিয়ে পরে নরপশুর দল। চালানো হয় মুহুর্মুহু গুলি। শুধু তাই নয়, কাতার করে দাঁড় করে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর করা হয় ব্রাশফায়ার। কাতারে কাতারে দাঁড় করিয়ে শতাধিক নারী পুরুষকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তবে ৭৮ জনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদাররা সেদিন চালায় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। যারা নৌকা দিয়ে পালাতে পেরেছিলেন তারা প্রাণে বেঁচে যান। কেউ কেউ ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে প্রাণরক্ষা করেন। হানাদাররা গণহত্যা করেই কান্ত হয়নি, বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জালিয়ে দেয়। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকাররা চালায় ব্যাপক লুটপাট। আতংক কেটে যাওয়ার পর নিহতের স্বজনরা বাড়িতে আসার আগেই শতাধিক লাশ নদীতে পঁচে ভেসে উঠে। ফলে পঁচা দুগন্ধের কারণে নিহতের স্বজনরা লাশগুলো সৎকার না করে পাশের নদীতে ভাসিয়ে দেন। কৃপেশ চৌধুরী গোপালের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, সেদিন আমার বয়স ছিল ৫ বছর নরপিচাশরা আমার মা, বাবা, ভাই-বোনসহ আমার পরিবারের ৯ সদস্যকে হত্যা করে। এ গ্রামের যুবক প্রদীপ দাশ জানান, ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট তৎকালীন ইউএনও মো. নুরে আলম সিদ্দিকীর প্রচেষ্টায় গ্রামে স্থাপিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ। এ স্মৃতিসৌধে গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিবছর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। হানাদার বাহিনীর নির্মমতায় শহীদদের মধ্যে যাদের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন, ক্ষীরেন্দ্র চৌধুরী, কর্ণমোহন চৌধুরী, কুপেন্দ্র চৌধুরী, কানু চৌধুরী, গীরেন্দ্র চৌধুরী, ধীরেন্দ্র চৌধুরী, নকুল দাশ, প্রমোদ চৌধুরী, অন্নদা চৌধুরী, মিরালাল চৌধুরী, জহর লাল দাশ, গুনেন্দ্র দাশ, হরেন্দ্র চৌধুরী, গুরুচরন চৌধুরী, রীবন্দ্র চৌধুরী, ফনিলাল দাশ, ইন্দ্রলাল দাশ, সরিন্দ্র দাশ, সুর মণি দাশ, অভিনয় চৌধুরী, গিরিষ চৌধুরী, জ্যোতিষ চৌধুরী, খোকা চৌধুরী, কুমেদ চৌধুরী, নুপেন্দ্র দাশ, লবুরাম দাশ, তরুণী দাশ, দীনেশ দাশ, ঠাকুর চান দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, কতন দাশ, সদয় চান দাশ, কুমোদিনী চৌধুরী, সরলাবালা চৌধুরী, ছানুবালা চৌধুরী, মিনুবালা চৌধুরী, তমালরাণী চৌধুরী, সুশীলা সুন্দরী চৌধুরী, নিত্তময়ী চৌধুরী, মুক্তলতা চৌধুরী, স্বপ্নারাণী চৌধুরী, ললিতা রাণী চৌধুরী, মিলু রাণী চৌধুরী, পিলু রাণী চৌধুরী, উজ্জল রাণী দাশ, সত্যময়ী দাশ, উন্মাদিনী দাশ, হেমালতা দাশ, সুচিত্রা বালা দাশ, ব্রম্মময়ী দাশ, শুসীলা বালা দাশ, চিত্রাঙ্গ দাশ, পিবদনাসিনী চৌধুরী, সোহাগী বালা দাশ, শৈলজবালা দাস, শোভা রাণী বালা দাশ, অঞ্জুরাণী দাশ, মরীরাণী দাশ, লক্ষীরাণী দাশ, সোমেশ্বরী দাশ, চিত্রময়ী চৌধুরী, শ্যামলা চৌধুরী, তরঙ্গময়ী চৌধুরী, সরুজনী চৌধুরী ও সরস্বতী চৌধুরী। আর এ বীর শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বানিয়াচংয়ের রাজাকাররা ৭১ সালের ১৮ আগষ্টের পর নৌকা বুঝাই করে নরনারী শুণ্য মাকালকান্দি গ্রাম থেকে সপ্তাহব্যাপী চাউল, ধান, কাপড়, চোপড়, সোনাদানা, খাট, পালং, চেয়ার-টেবিল, কাঁথা-বালিশ লুট করতে থাকে। কেউ কেউ লুট আনতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। ৪৫ বছর পরও যেমনি করে পায়নি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি তেমনি হয়নি ওই সময়কার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।