নেত্রকোনায় বিলুপ্তির পথে ৬৪ প্রজাতির মাছ

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফেরদৌস আহমদ, নেত্রকোনা

এককালে মৎস্য ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাতি ছিল নেত্রকোনার। দেশের দূর-দূরান্ত এলাকা, এমনকি রাজধানী ঢাকা থেকেও মাছ দেখার জন্য লোকজন আসতেন নেত্রকোনায়। জেলার হাওরাঞ্চল মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুরিসহ কলমাকান্দা, বারহাট্টা, জেলাসদর, আটপাড়া, কেন্দুয়া, দুর্গাপুর, পূর্বধলা প্রভৃতি উপজেলা সমূহের বিভিন্ন হাটবাজারে মাছের বিশাল জোগান দেখে তারা চোখের সাধ মেটাতেন। ফেরার পথে পরিবার পরিজনের জন্য সস্তায় কিনে নিয়ে যেতেন বিপুল পরিমাণ মাছ। এখন তা শুধুই ইতিহাস।

বিভিন্ন কারণে জেলার হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, নদী ও নালাসমূহে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন প্রকার মাছ হ্রাস পাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এই অবস্থার। বিভিন্ন উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে টাটকিনি, ঘারুয়া, চাকা, বাঘাইর, রিঠা, রানি, পাঙাশ, বামোশ, নাফতানী, চিতল, একথুটি, মহাশোল ও সরপুঁটি মাছ ‘মহাবিপন্ন’ অবস্থায় রয়েছে। ‘সংকটাপন্ন’ অবস্থায় রয়েছে বাচা, ছেপ চেলা, ঢেলা, বাঁশ পাতা, কুঁচে, নাপতে কই, রায়েক, কাক্কিয়া, টেংরা, ফলি, গুজি, আইড় প্রভৃতি প্রজাতির মাছ। এছাড়া, গোলসা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড় বাইম, গজার, তাঁরা বাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা, কালিবাউস, নান্দিনা, ঘোড়া, মধু পাবদা, খাশ খাইরা, এলং, তিলা শোল, খলিশা, ভেদুরী, মেনি, শালবাইম, গাং মাগুর প্রভৃতি প্রজাতির মাছ রয়েছে ‘বিপন্ন’ অবস্থায়। জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনায় ছোট বড় ১২টি নদী, ৬৬টি হাওর, ৪৫৬টি বিল ও ১৮৩টি খাল রয়েছে। হাওর, বিল ও জলাশয় রয়েছে ৪৮ হাজার ৯১৩ দশমিক ২৯ হেক্টর।

এসব উৎস থেকে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ৭২ দশমিক ৯১ মেট্রিকটন মাছ আহরণ করা হয়। তবে এক দশক আগে মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল আরো বেশি। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশি প্রজাতির অনেক মাছের বংশবিস্তার হচ্ছে না। আগের মতো হাওরে পর্যাপ্ত পানি না থাকা, ‘পাইল ফিশিং’ (দুই-তিন বছর নির্দিষ্ট এলাকায় মাছ না ধরা) না হওয়া এবং হাওরে নতুন পানি আসার সময় কারেন্ট জাল ও চায়না বাইর দিয়ে অবাধে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা ধরার কারণে দেশি প্রজাতির অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে বা বিলুপ্তির পথে রয়েছে। বর্তমানে কিছু খামারি তাদের ফিসারির মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, কই, পাবদা, টেংরা প্রভৃতি প্রজাতির মাছের চাষ করছেন। তবে, উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা মাছের তুলনায় স্বাদ কম থাকায় কৃত্রিমভাবে চাষকৃত মাছের প্রতি ভোক্তা-সাধারণের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। প্রতি বছর সরকারের পক্ষ হতে অনেক জলাশয়ে বিদেশি জাতের বিভিন্ন মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়।

দেশীয় জাতের মাছ সংরক্ষণ, পোনা অবমুক্তকরণ বা সংরক্ষণের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই মৎস্য কর্মকর্তাদের, অনেকের অভিযোগ। মৎস্য বিশেষজ্ঞ মাসুদ আলম খান বলেন, ‘মাছের উৎপাদন ও বিলুপ্তি ঠেকাতে হাওরের জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মা মাছের নির্বিঘ্নে বেড়ে ওঠা ও প্রজননের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ বিচরণস্থল তৈরি করতে না পারলে কোনোভাবেই মাছের বিলুপ্তি রোধ করা সম্ভব হবে না।’ নেত্রকোনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহ্জাহান কবীর বলেন, ‘হাওরে নতুন পানি আসার সময়টুকু অর্থাৎ জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে মাছ আহরণ একেবারে বন্ধ রাখতে পারলে দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে। অনেকে আইন অমান্য করে শুকনো মৌসুমে সেচে জলাশয় শুকিয়ে মাছ আহরণ করে থাকেন। এটি মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারলে মাছের বিলুপ্তি অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব। বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করার জন্য হাওরে মাছের স্থায়ী অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।