বাঁশখালীর সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বালু উত্তোলন

হুমকির মুখে পরিবেশ, ধ্বংস হচ্ছে রাস্তাঘাট

প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের, বাঁশখালী

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় পুঁইছড়ি ছড়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু। পাহাড়ের পাদদেশে এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের বিশাল সিন্ডিকেট। পাহাড়ের পাদদেশে বেয়ে আসা ছড়া হতে বালু উত্তোলনের ফলে একদিকে যেমন বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে পাহাড় ধসে বিশাল ক্ষতি সম্মুখীন হচ্ছে বনভূমি।

তার সঙ্গে পাচার করা হচ্ছে গাছ পালা। নষ্ট হচ্ছে রাস্তা ঘাট। পাহাড়ের পাশের ছড়াগুলোর বালু কেটে পাচার করায় এগুলো বর্তমানে নদীর রূপ নিচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এসব কর্মকাণ্ডে বাধা না দিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। গাছ পাচার, পাহাড় ও ছড়া কাটার ক্ষেত্রে কেউই বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করছে না। পাহাড় কেটে ও ছড়া থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট হচ্ছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ পাহাড় ও সবুজ বনভূমি, বর্তমানে এই বনভূমি চুনতি অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিন দিন মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে।

সরেজমিন পরির্দশন কালে দেখা যায়, পুঁইছড়ি ইউপির পূর্ব পুঁইছড়ি ৫নং ওয়ার্ডে বহরাতলী এলাকায় অর্থাৎ (প্রেমবাজার থেকে পূর্বে ৩ কিলোমিটার দূরে এই বালুমহাল। ওই চড়ার অন্তত ৬-৭টি স্পট থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে। প্রেমবাজার থেকে পূর্ব দিকে রওনা দিতেই দেখা যায়, পুরো ৩ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খুবই লাজুক। এই যেন এক বালুর হাট-বাজার। প্রতি ১০ মিনিটের মাথায় একের পর এক বালুভর্তি ট্রাক আসছে আর যাচ্ছে। রাস্তাজুড়ে ধূলো আর ধুলা। স্থানীয়রা জানান, জঙ্গল পুঁইছড়ি বালুমহালের ইজারা ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বাতিল করে জেলা প্রশাসন। এর আগে ২০১৯ সালে স্থানীয় ঠিকাদার মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ২২ লাখ ৫৩ হাজার টাকায় জঙ্গল পুঁইছড়ি বালুমহাল ইজারা নিয়েছিলেন।

কিন্তু বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যাওয়ার অভিযোগে বালুমহালের ইজারা বাতিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন। বরং দিনের পর দিন আরো বেশি করে বালু তুলছেন একটি প্রভাবশালী বালু সিন্ডিকেট। ফলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে হাজার হাজার ফসলি জমি, জীববৈচিত্র্য, ঘরবাড়ি, বসতভিটা, রাস্তাঘাট, মসজিদ, কবরস্থান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যবান জাতীয় সম্পদ বিলীন হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের বিপর্যয় গড়ছে। স্থানীয়রা আরো জানান, প্রতিদিন তারা ১০০ থেকে ২০০ ট্রাক বালু বিক্রি করেন। ট্রাকযোগে বালুগুলো বিভিন্ন এলাকায় স্পলাই দেওয়া হয়। প্রতি ট্রাক বালু ২৫ শত টাকা করে। এর বাইরে গাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করা হয় স্থান বুঝে। আবার ঘরোয়া ক্রেতারা স্থানভেদে কিনছেন ৪ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায়। বালু মহলের ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা খলিলুর রহমান জানান, আমরা প্রতি ট্রাক বালু ২৫০০ টাকা করে বিক্রি করি। এর বাইরে স্থান বুঝে গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। আপনাদের বালুমহলে কোনো সরকারিভাবে কোনো ইজারা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ইজার আছে বলেন! কেউ যদি আটকায় বালুর ট্রাক? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা ইজারাদারের পক্ষ থেকে প্রতি ট্রাকের ড্রাইভারকে একটি টোকেন দিয়ে থাকি। এই টোকেন দেখলে পুলিশ প্রশাসন, বন বিভাগ এবং উপজেলা প্রশাসন কেউ আমাদের গাড়ি আটকাবে না। নাম প্রকাশ না করায় বেশ কয়েকজন জানান, পূর্ব পুঁইছড়ি এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের ফলে একদিকে রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে।

অবৈধভাবে বালু ও মাটি বিক্রির ফলে দিন দিন বিলীন হতে বসেছে, পূর্ব পুঁইছড়ি এলাকার অধিকাংশ বসতঘর। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল খালেক পাটোয়ারী জানান, বাঁশখালীতে বেশ কয়েকটি স্পটে ইজারা যোগ্য বালু মহল আছে; কিন্তু কোথাও কোনো ধরনের বালু মহল ইজারা দেওয়া হয়নি। গত বছর ১টি মাত্র ইজার ছিল, সেটিও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে কোথাও কোনো বালু মহল ইজারা দেওয়া হয়নি। যদি কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে থাকে, শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হলে সেই যেই কেউ হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করে বালুখেকোদের দাপট বন্ধ করা হবে।