যমুনার এঁকেবেঁকে চলা জলরাশির মধ্যে দ্বীপের মতো ছোট্ট একটি নন্দন ভূমি। এ চরে নেই কোনো সুন্দরী বা গেওয়া, গরান, কেওড়া গাছ। তবে চরটি ‘সুন্দরবন’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে। এই সুন্দরবনে দেখা মেলে না কোনো কুমিরের পায়ের ছাপ, নেই দল বেঁধে ছুটে চলা হরিণ, কিংবা বাঘ। কিন্তু এই বনে দেখা যায় ছুটে চলা গরুর পাল। আর ঘোড়া-মহিষ। তবে, কেমন যেন নামটা, প্রথম শোনায় চমকে ওঠার মতো ধারাবর্ষার চর। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে যমুনার তীরে কালিতলা ঘাট। কালিতলা গ্রোয়েন পয়েন্ট থেকে ১৮ কিলোমিটার পূর্বে চরে পৌঁছাতে হয় নৌকায়। নৌকাযোগে এই ধারাবর্ষার চরে যেতে লাগে প্রায় আড়াইঘণ্টা। বনায়ন কয়েক হাজার গাছের কাছেই খেয়াঘাট। চরের কাছেই পলি পড়ে আরেকটি চর জেগেছে। শান্ত-স্নিগ্ধ এ চরে ভরা চাঁদের রাতে জ্যোৎস্নায় যমুনায় তাকালে মনে হবে আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে ধরনিতে। শান্ত ঢেউয়ের সঙ্গে ধ্রুপদী নাচনে মাতিয়ে তুলেছে ভুবন। এই সময়ে ভ্রমণপিয়াসীদের কেউ সংগীত যন্ত্রে আনন্দের সুর তোলে। কেউ বেহালায় সুর তোলে বেদনার। যে আনন্দণ্ডবেদনা, সুখণ্ডদুঃখ নিয়েই মানুষের জীবনপ্রবাহ বয়ে চলে স্রোতের মতো। স্থানীয়রা জানান এই চর ক্ষণস্থায়ী। বর্ষায় নদীর পেটে চলে যায়। তবে মূল ধারাবর্ষা চর জেগে থাকে দ্বীপের মতো। চরে নেমে ভ্রমণপিয়াসী এক পর্যটক বললেন, বিদেশের মাটিতে এমন এক নিসর্গ দেখেছেন। ধারাবর্ষা যেন অপার নিসর্গ।
সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি চরগ্রাম। তারমধ্যে ধারাবর্ষা একটি। সারিয়াকান্দি উপজেলায় বোহাইল ইউনিয়নে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে ১২০০ একর জমিতে এই বনাঞ্চল। প্রায় ৩৫ বছর আগে চরটি খুঁজে বের করেছিলেন বগুড়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুজ্জামান ভূঁইয়া। বন বিভাগের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছিলেন বনায়নের নিসর্গের ভূমি। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, কাঠুরিয়ার কুড়ালের আঘাতে এই বনভূমি থেকে অনেক গাছ উধাও হয়ে গেছে। কিছু টিকে আছে। অনেক গাছ আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তারপরও যমুনার বুকে জেগে থাকা চরের পরিচয়ে একটি দ্বীপ ভূমি। যার নাম ধারাবর্ষা। যমুনার স্রোত কখনো অশান্ত হলে ধারাবর্ষার কোনো পরিবর্তন হয় না। ধারাবর্ষা চরে জনবসতি রয়েছে প্রায় ৭ হাজার। যাদের পেশা কৃষি। তাদের উৎপাদিত সবজিপণ্য বিভিন্ন জায়গার পাইকাররা এসে নিয়ে যায়। চরের বাসিন্দা খবির হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামের এই চরের বন দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে। যদি এই বনের দিকে সরকার সুদৃষ্টি দেয়, তাহলে আমাদের এলাকার লোকজনদের রোজগারের ভালো একটা পথ হবে। বিভিন্ন সংগঠন ভরাচাঁদের পূর্ণিমা রাতে চরে তাঁবু খাটিয়ে উৎসবের আয়োজন করে। ধারাবর্ষার বনায়নের কাছেই খেয়াঘাট। এই ঘাটে দেখা যায় ডিঙ্গি নৌকা। এ যেনো চরের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বোহাইল ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি মহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের চরের ভূমি উর্বর। সব ফসল ফলে। যমুনায় এত সুন্দর একটি চর আছে তা অনেকেরই অজানা। চরের ওপারেই জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলা। ধারাবর্ষা চরগ্রাম চারভাগে বিভক্ত, পূর্ব-পশ্চিমণ্ডউত্তর-দক্ষিণ। যমুনার বুকে এই প্রাচীন দ্বীপ পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো। এই ধারা বর্ষার চরে পর্যটকদের আগমন দিন দিন বাড়ছে। সরকারিভাবে এখানে যদি পর্যটকদের জন্য আবাসন তৈরি করা হয়, পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে এটি আমাদের বগুড়া জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।