হারিয়ে গেছে একসময়ের গ্রামবাংলার বাহন ঘোড়া ও গরুর গাড়ি

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলমগীর সিদ্দিকী, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা)

একসময় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন হিসেবে ঘোড়া ও গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। গ্রামবাংলায় ঘোড়া ও গরুর গাড়িই ছিল যোগাযোগের একমাত্র বাহন। কালের গ্রাসে আধুনিকতার স্পর্শে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি এখন শুধুই অতীতের স্মৃতি। গ্রামগঞ্জের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ধীরে ধীরে বয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি এখন আর চোখে পড়ে না। মাত্র দুই যুগ আগেও পণ্য পরিবহন ছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনে বহনের বিকল্প কোনো বাহন কল্পনাই করা যেত না। যেসব পরিবারে ঘোড়ার গাড়ি ছিল, তাদের কদর ছিল আলাদা। কৃষকরা আগে ঘোড়া এবং গরুর গাড়িতে গোবর, সার, লাঙল-মই-জোয়াল নিয়ে মাঠে যেত। প্রাচীনকাল থেকে দেশের গ্রামীণ জনপদে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে গরুর গাড়ির ছিল বহুল প্রচলন। পায়ে চলার পথে মানুষ ঘোড়ার গাড়িকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ও বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণেও এটি ছিল অপরিহার্য। অনেকেরই এই গাড়ি ছিল উপার্জনের অবলম্বন। গ্রামের বউ-ঝিরা নাইওর যেত ঘোড়ার গাড়িতে।

সময়ের বিবর্তনে আজ ঘোড়ার গাড়ির চালক (গাড়িয়াল) না থাকায়, হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা গাড়িয়াল ভাইয়ের কণ্ঠে সেই অমৃত মধুর সুরের গান। লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে আনন্দে গাড়িয়ালরা গাইতো- ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে...।’ এখন ‘চাইয়া’ থাকলেও ঘোড়ার গাড়ি আর গরুর গাড়ি চোখে পড়ে না। আর গানও গায় না গাড়িয়ালরা। কাশিমাড়ী গ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সবুর মোল্লা বলেন, ‘আগে আমাদের এলাকায় গরুর গাড়ির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ৪০ বছর আগে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই একটি করে গরুর গাড়ি ছিল। অনেক বিত্তবান পরিবারে ২-৪টি পর্যন্ত গরুর গাড়ি ছিল। গরুর গাড়ির আয়ের ওপর নির্ভর করেই চলত ওইসব পরিবার। কিন্তু এখন বাস, মাইক্রোবাস, নছিমন, পিকিআপ, ভ্যানগাড়ি, অটো আগমনসহ নানা কারণে ঘোড়ার গাড়ি এবং গরুর গাড়ি হারিয়ে গেছে।’ শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া গ্রামের প্রবীণ ঘোড়ার গাড়ি চালক, সাদেক আলীর দেখা মিলে বৃহস্পতিবার সকালে রমজাননগর গ্রামে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে। তার কাছে জানতে চাইলে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন তিনি বলেন, কৈখালী গ্রামে আমার শশুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, এক সময় আমি যখন শশুর বাড়ি আসতাম তখন আমার নিজস্ব ঘোড়ার গাড়িতে আমার বউকে সাথে নিয়ে আসতাম। প্রবীণ ব্যক্তি তাজ মিয়া বলেন, ‘এখন যেমন আমরা নিজেদের ব্যবহারের জন্য প্রাইভেট কার বা মাইক্রো কিনি, এক সময় তেমনি গ্রামের লোকজন ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ি তৈরি করে বাড়িতে রাখতেন। আপদে-বিপদে তারা বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন।’ কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণ নগর গ্রামের শহিদ মিয়ার সাথে হঠাৎ দেখা মিলে বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার জয়নগর এলাকায় তিনি জানান, ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আমি ঘোড়ার গাড়ি এখনও রেখেছি হাট থেকে একটি ঘোড়াসহ ঘোড়ার গাড়ি ৭০ হাজার টাকায় ক্রয় করেছি। তিনি বলেন, শহরে মালামাল বহন করার জন্য অন্যান্য গাড়ির চেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে কম খরচে মানুষ মালামাল বহন করতে পারবে। উপজেলার কাশিমাড়ী গ্রামের ঘোড়ার গাড়িয়াল মাহতাব বলেন, ‘আজ থেকে ৩০- ৪০ বছর আগে আমি ৫ জনের পরিবার চালাতাম ঘোড়ার গাড়ি ভাড়ায় খাটিয়ে। কিন্তু এখন তো কোথাও ঘোড়ার গাড়ির দেখা পাওয়া যায় না।’ কাশিমাড়ীর ইউপি সদস্য বাবলু বলেন, নতুন প্রজন্মকে ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে আমাদের এখন জাদুঘরে যেতে হবে। আধুনিকতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরু ও ঘোড়ার গাড়ি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গাড়িয়াল পেশাও। যা ছিল একসময় বংশপরম্পরায় পেশা। সময় অতিবাহিত হবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ধারক-বাহক অনেক বাহনেরই আমূল পরিবর্তন-আধুনিকায়ন হয়েছে। আজ শহরের ছেলেমেয়ে দূরে থাক, গ্রামের ছেলেমেয়েরাও ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়ির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত না। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রকৃতিবান্ধব ঘোড়ার গাড়ি বহুবিধ কারণে বর্তমানে হারিয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও কালেভদ্রে দুয়েকটি ঘোড়া ও গরুর গাড়ির দেখা মিললেও বর্তমানে তা দেখা যায় না। ঐতিহ্যের স্বার্থেই এ বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।