বাক বাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা, বউ সাজবে কাল কি, চড়বে সোনার পালকি।’ ছড়াটিতে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পালকি সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। শ্যামনগর উপজেলায় বিয়ের বর ও কনের বহনের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন পালকি এখন আর দেখা যায় না। শোনাও যায় না। চতুর দোলাতে চড়ে বধূ যায় হুন্না, হুন্না। ৪০-৪৫ বছর পূর্বে দেশে বিয়ের সময়ে অত্র এলাকায় একমাত্র ব্যবহার হতো পালকি। পালকি ঘিরে কত হাসি তামাশার গল্প আজও শোনা যায় দাদা-দাদি বা মায়ের কাছ থেকে- তা নিতান্তই রোমাঞ্চকর বটে। নানা ঘটনার সাক্ষী এই পালকি আজ হারিয়ে গেছে। এ ছাড়াও পালকি যাতায়াতসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতো। এই বাহনে এক বা দুইজন যাত্রী নিয়ে পালকি ব্যবহার করা হতো। এটিকে কাঁধে তুলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেত ৪ বা ৮ জন বাহক। রাতে বিবাহ হতো ভোরবেলা পালকিতে করে বর ও কনেকে ৮ জন বাহক দিয়ে দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিয়ে তাদের নিয়ে আসা হতো। সেকি আনন্দ তা আজ আর নেই। আসার পথে বাহকরা বর-কনেকে নিয়ে বিভিন্ন ছন্দে ছন্দে গান পরিবেশন করে গ্রামগঞ্জের রাস্তা পাড়ি দিত। অপরদিকে বরের বাড়িতে কুলোতে ধান দূর্বা নিয়ে নববধূকে বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত বরের মাতা ও বোনেরা।
পালকিতে চড়ে বর ও কনে বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই ধান ও দূর্বা ছিটিয়ে তাদের বরণ করত এবং বাড়ির লোকজনরা কাদামাটি ও রং ছিটিয়ে উল্লাস করত। সেই রংবেরঙের পালকির সন্ধান আর নেই। আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করত। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল। এছাড়াও অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসালয়ে নেওয়ার জন্য পালকি ব্যবহার হতো। পালকি বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের হয়ে থাকে। সবচেয়ে ছোট সাধারণ পালকি দুইজনে ব্যবহার করে। সবচেয়ে বড় পালকি বহন করে ৪-৮ জন বাহক। পালকির বাহকরা এর পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন কাজ করত। বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ১০-১২ দিন পূর্ব থেকেই পালকির বাহকদের ও মালিকদের বুকিং করে রাখা হতো। তবে পালকি সচরাচর তিন ধরনের হয়ে থাকে। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি ও ময়ূরপঙ্খী পালকি। ওইসব পালকিতে কাঠের তৈরি পাখি, পুতুল ও লতাপাতা নকশা দিয়ে তৈরি হতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে অবস্থানকালে তার জমিদারি কাছারি পরিদর্শনের সময় পালকি ব্যবহার করতেন। ১৯৩০-এর দশকে শহরাঞ্চলে রিকশার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার ক্রমশ উঠে যায়। যোগাযোগব্যবস্থা ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যান চলাচল এবং প্যাডেল চালিত রিকশা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।