ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অনুকূল পরিবেশের অভাব

নিভে যাচ্ছে জোনাকির আলো

নিভে যাচ্ছে জোনাকির আলো

এক সময় সন্ধ্যা হলেই কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার জনপদের ঝোপঝাড়ে দেখা যেত শরীরে পিদিম জ্বালিয়ে মিটমিট করে জ্বলা জোনাকি পোকার ছোটাছুটির দৃশ্য। সময়ের পরিক্রমায় বনানী স্বল্পতা ও আধুনিকতার বদৌলতে পাওয়া আলোক দূষণের ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জোনাকি পোকা। এখন আর আগের মতো এই জনপদে দেখা মেলে না এদের। দেখা যায় না রাতের অন্ধকারে শরীরজুড়ে মিটমিট করে জ্বলা তারার মতো জোনাকির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সচেতন মহলের দাবি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জোনাকি পোকা দেখতে পায়, সে লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব জোনাকি পোকা সংরক্ষণ করা হোক। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে জানা গেছে, জোনাকি হলো ল্যামপিরিড পতঙ্গ পরিবারের একটি গোবরে পোকা, বর্গ হলো কলিওপ্টেরা। বাংলায় এর নাম তমোমণি। এরা মূলত পাখাওয়ালা গোবরে পোকা, যাদের সাধারণভাবে জোনাকি পোকা বলা হয়। কারণ তারা জৈব রাসায়নিক ব্যবস্থায় নিজের শরীর থেকে আলো উৎপন্ন করে। এরা এই আলো যৌন মিলন ঘটানোর কাজে বা শিকারের উদ্দেশ্যে জ্বেলে থাকে। এরা কোল্ড লাইট বা নীলাভ আলো উৎপন্ন করে কোন আল্ট্রাভায়োলেট বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাড়াই। এ আলোর রং হলুদ, সবুজ বা ফিকে লাল হতে পারে। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হলো ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার। ভেজাকাঠ, ঝোপঝাড়, ডোবায় জোনাক পোকা বংশবিস্তার করে থাকে। আরো জানা গেছে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে জোনাকি পোকা। বিভিন্ন প্রাণী যেমন সাপ ও ব্যাঙের খাবার জোনাকি পোকা ও এদের লার্ভা। যা বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব রাখে। চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের বন্যপ্রাণী গবেষক নাসির উদ্দিন বলেন, জোনাকি পোকা ফুলের পরাগ এবং মধু খায় এতে এক ফুলের পরাগ অন্য ফুলে দিয়ে পরাগায়নে সহায়তা করে থাকে। যা কৃষকের খাদ্যশস্য ফলাতে সহায়তা করে। তিনি বলেন, একটি এলাকায় জোনাকির উপস্থিতি ওই এলাকার পানির গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। যদি পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, তবে সেই এলাকায় জোনাকি পোকা থাকে না। জোনাকির শরীরে লুচিফেরিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। যা ক্যান্সার, চর্মরোগ, সিস্টিক ফ্যাব্রোসিস এবং হৃৎপিণ্ডের নানা রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কাজেই জোনাকি সংরক্ষণ ও পোকাটি নিয়ে আরো গবেষণার দরকার আছে বলে উল্লেখ করেন নাসির উদ্দিন। এদিকে আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরাও জোরালোভাবে জানান জোনাকি পোকার প্রক্ষেপিত কোমল আলো আমাদের ওষুধ শিল্প উন্নয়নে মুখ্য ও যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা চলমান রেখেছেন বলে জানা গেছে। কীট তত্ত্ববিদদের মতে, পৃথিবীতে সব রকমের আলোর মধ্যে জোনাকির আলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর, স্মার্ট ও পরিবেশবান্ধব। কিছু প্রজাতির পুরুষ জোনাকি রাতের বেলা তার নিজস্ব শৈলীতে আলো জ্বেলে নারী জোনাকি পোকাকে তার দিকে আকৃষ্ট করে থাকে। আর স্ত্রী জোনাকিরাও পুরুষ জোনাকির এরূপ আলো জ্বালানোর নিপুণ শৈলীর ওপর ভিত্তি করে সঙ্গী নির্বাচন করে থাকে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডগ্রাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি সন্ধ্যা হলেই বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়ে, পুকুর ও খালের পাড়ে জোনাকি পোকা আলো জ্বালিয়ে ওড়াউড়ি করত। এ দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগত। আমরা জোনাকি পোকা জামার পকেটে নিয়ে ঘুরতাম। জামার পকেটে মিটমিট করে আলো জ্বলত, এতে আমরা উল্লসিত হতাম। কিন্তু এই সময়ে এসে জোনাকি পোকা দেখা যায় না বললেই চলে। দীর্ঘভূমি বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমির হোসেন বলেন, জোনাকি পোকা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। এটা দিন দিন অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার ও অপরিকল্পিতভাবে বন উজাড় ও গাছকাটার কারণেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। জোনাকি পোকা টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের বাসযোগ্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিন বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ ও গাছপালা কর্তনের ফলে জোনাকি পোকার আবাসস্থল কমছে। আধুনিক সময়ে অতিরিক্ত আলোকসজ্জার কারণে আলোক দূষণ বাড়ছে। এ পরিবেশ জোনাকি পোকার জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি। এতে করে দিন দিন জোনাকি পোকা পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। জোনাকি পোকা সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জোনাকি পোকার আবাসস্থল নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত