বিলুপ্তির পথে দিনাজপুরের তিলের খাজা

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাতে দিনাজপুরের তিলের খাজার উপস্থিতি মেলে। শত বছরের এই খাদ্য পণ্যটি এখন ক্ষুদ্র শিল্পে রূপ নিলেও বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। দিনাজপুর ছাড়াও এটি উৎপাদিত হয় অন্য জেলাতেও। বাবা-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রেখেছে কিছু পরিবার। তবে আধুনিকতার এই সময়ে এসেও সনাতন পদ্ধতিতেই হাতে তৈরি হয় তিলের খাজা। এই খাজার রয়েছে ‘সমৃদ্ধ ইতিহাস’।

দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় দিনাজপুরের তিলের খাজা স্থান করে নিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও দারুণভাবে এগিয়ে স্বল্পমূল্যের এই স্থানীয় খাবারটি। দিনাজপুরে ঠিক কবে থেকে এই তিলের খাজার উৎপাদন শুরু হয় এর সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ইতিহাস অনুসারে, অবিভক্ত ভারতের উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাঁতীপাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহন্ত সম্প্রদায়ের ৮-১০টি পরিবারের মানুষ এ খাবার তৈরি করতেন। দিনাজপুরের ইতিহাস সন্ধানী কিছু মানুষের বিশ্বাস, ১৯০০ সাল বা তার আগে পরের কাছাকাছি সময়ে ‘তাঁতী’ সম্প্রদায়ের লোকদের মাধ্যমে এই খাবারটি প্রথম দিনাজপুরে তৈরি হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ওই গ্রামে ‘তাঁতী’ সম্প্রদায়কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি পরিবারকে ১০-১৫ বছর আগেও তিলের খাজা তৈরি করতে দেখা যেত। তাঁতী পাড়ায় কয়েকটি খাজা তৈরির পারিবারিক কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু তিলের দুঃপ্রাপ্ততা, চিনি-গুড়ের দাম বৃদ্ধি ও কঠোর পরিশ্রমের উপযুক্ত মজুরি ও খাজা তৈরির জন্য আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত না হওয়ায় দিনাজপুরে ধীরে ধীরে তিলের খাজা তৈরি বিলুপ্ত হতে থাকে। পেশা পরিবর্তন করে অনেকে চলে যান অন্য পেশায়।

কিন্তু বাবা-দাদার পেশাকে বদলাতে পারেননি ওই গ্রামের শংকর মহন্ত। স্ত্রী, ছোট ভাই ও পরিবারের অন্যান্য ১০ জন সদস্যকে নিয়ে এখনো তৈরি করেন তিলের খাজা। দিনাজপুরে একমাত্র তার পরিবারই এই তিলের খাজা তৈরি করছে। তৈরির উপকরণ ও প্রক্রিয়া : সাধারণত ২ ধরনের তিলের খাজা তৈরি হয়ে থাকে। একটি তৈরি হয় চিনি, অন্যটি গুড় দিয়ে। চিনি বা গুড়ের সঙ্গে থাকে তিল। বড় লোহার কড়াইয়ে চিনি বা গুড় জ্বাল দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট তাপের পর তা চুলা থেকে নামানো হয়। হালকা ঠান্ডা হলে মিশ্রণটি জমানো সিরা বা ‘লই’ হয়। ওই সিরাকে শিংয়ের মতো গাছের ডাল বা লোহার আংটায় আটকে নিয়ে হাতে টানা হয়। এক পর্যায়ে তা বাদামি থেকে সাদা হলে কারিগররা বিশেষ কায়দায় তা হাতের ভাজে ভাজে টানতে থাকেন। তখন এর ভিতরটা ফাঁপা হতে থাকে। ফাঁপা অংশগুলোকে বারবার টেনে টেনে ভাঁজ করা হয়, যাতে করে ভেতরে ফাঁপা ছিদ্র অনেক বেশি হয়। এরপর তা টেনে লম্বা করে রাখা হয় পরিষ্কার স্থানে। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল।

এভাবেই তৈরি হয় ‘তিলের খাজা’। শংকর মহন্ত জানান, আরো এক ধরনের তিলের খাজা তারা তৈরি করেন। তাতে দুধ মেশানো হয়। এর উপকরণ দুধ, চিনি ও তিল। তবে সেটা খুব কম। অর্ডার পেলে তৈরি করে দেওয়া হয়। বাড়ির সমানে উঠনে তিনদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ‘তিলের খাজা’ তৈরি হয়। চিনি ও গুড় স্থানীয় বাজার থেকে কেনা হলেও তিল কেনা হয় যশোর, ফরিদপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে। তবে ভালোমানের তিল পাহাড়ি অঞ্চল থেকেও সংগ্রহ করা হয়। প্রতি কড়াইয়ে ৭ কেজি চিনি অথবা গুড়, ৪ লিটার পানি আর দেড় কেজি তিল থেকে প্রায় ৮ কেজি খাজা হয়। প্রতিদিন তিনি পরিবারের ১০ জন সদস্যকে নিয়ে ৪০ কেজি খাঁজা তৈরি করতে পারেন। যা বাজারে বিক্রি করেন পাইকারি ২৪০ টাকা কেজি। এতে যা লাভ হয় তাতে সংসার চলে যায়।