নামে খেজুরের গুড়, আসলে চিনি

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে গাছগুলো আছে তাতেও তেমন রস পাওয়া যায় না। ফলে গুড় তৈরির কাঁচামাল খেজুর রসের সংকট রয়েছে। আর এ অধিক চাহিদাকে কেন্দ্র করে গুড়ে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। জেলার চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়া উপজেলাজুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে চারঘাটে এক লাখ ৮৪ হাজার ২৭৫টি, পুঠিয়ায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ১২৫টি ও বাঘায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৫১২টি খেজুর গাছ রয়েছে। তবে প্রতিবছরই এসব উপজেলায় গড়ে ৫-৭ হাজার গাছ কমে যাচ্ছে। চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়া এই তিন উপজেলা সংলগ্ন রাজশাহীর সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট বসে পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারে। প্রতিদিন এ হাটে ৯০-১১০ টন এবং সপ্তাহে দুদিন বড় হাটে ১২০-১৫০ টন গুড় আমদানি হয়। এছাড়া চারঘাটের বাঁকড়া ও নন্দনগাছী, বাঘার বিনোদপুর, মনিগ্রাম ও আড়ানী এবং পুঠিয়ার ঝলমলিয়া হাটে শত শত টন গুড় বেচাকেনা হয়। প্রতিদিন ভোর থেকে ভ্যান, নসিমনসহ বিভিন্ন যানবাহনে আশপাশের এলাকা থেকে হাটে গুড় আসে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি খেজুর গাছ থেকে গড়ে চার কেজি গুড় উৎপাদন হয়। সে হিসেবে চারঘাটে ৭৩৭ টন, পুঠিয়ায় দুই হাজার ৩০৮ টন এবং বাঘায় প্রায় ৫০০ টন গুড় উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি খেজুর গুড় আসছে বাজারে। যার বেশিরভাগ গুড়ই গাছিরা তৈরি করেন না, বরং গাছিদের রস কিনে নিয়ে কারখানায় আলাদাভাবে ভেজাল গুড় তৈরি করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, বর্তমান বাজারে প্রতিকেজি চিনির দাম ১৩০-১৪০ টাকা। অন্যদিকে প্রতিকেজি গুড় বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৮০ টাকা কেজি দরে। প্রতি ৬০ কেজি গুড় তৈরিতে খেজুর রসে মেশানো হচ্ছে ৪০-৪৫ কেজি চিনি। দাম ও মান অনুযায়ী চিনি মেশানোর পরিমাণ বাড়ানো-কমানো হয়। যে পরিমাণ চিনি মেশানো হয় তাতে খেজুর গুড়ের অস্তিত্ব থাকছে না। বরং চিনি ও আটা খেজুরের গুড়ে মিশিয়ে বেশি লাভে বিক্রি করছেন তারা। বাঘা উপজেলার আড়পাড়া এলাকার গাছি কামাল আলী বলেন, ‘খেজুর গুড়ের সেই স্বাদ ও গন্ধ আর নেই। বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিতে আমরাও চিনি দিচ্ছি তবে কম। কিন্তু যারা কারখানায় গুড় তৈরি করছেন তারা গুড়ের অস্তিত্বই রাখছেন না।’ পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজারের পাইকারি গুড় ব্যবসায়ী সুফেল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা গুড় তৈরি করি না। গুড় পাইকারি কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করি। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত চিনিমিশ্রিত ভেজাল গুড় তৈরির কারণে কোটি কোটি টাকার গুড়ের ব্যবসা এখন ক্ষতির মুখে। প্রতিবছরই গুড়ের বাজার বড় হচ্ছে কিন্তু সুনাম হারাতে বসেছে রাজশাহীর গুড়।’ খেজুর গুড় উৎপাদনকারীরা চিনি মিশিয়ে গুড়ের উৎপাদন বাড়ানোর কথা বললেও উল্টো যুক্তি দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ইটভাটায় পোড়ানোসহ নানা কারণে কিছু উপজেলায় প্রতিবছর গাছের সংখ্যা কমছে। তবে গুড়ের উৎপাদন বাড়ছে রস নষ্ট না হওয়ার কারণে। আগে মানুষ কাঁচা রস খেতো। নানাভাবে নষ্টও হতো। কিন্তু এখন মানুষ সচেতন হওয়ায় সব রসই গুড় তৈরির কাজ ব্যবহার হচ্ছে। এজন্য গাছের পরিমাণ কমলেও গুড়ের উৎপাদন বাড়ছে। গুড়ে ভেজাল দেওয়ার বিষয়টি লোকমুখে শুনেছেন বলে জানান তিনি। এসব ভেজাল গুড় স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমান বলেন, চিনি ও কেমিক্যাল মিশ্রিত গুড় খেলে আলসার, ডায়রিয়া, কলেরাসহ পেটের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে ওই গুড় দিয়ে শিশুদের কোনো খাদ্য তৈরি করে খাওয়ালে শিশুরা কিডনি, হার্ট, ব্রেন ও লিভার ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ জটিল রোগেও আক্রান্ত হতে পারে। রাজশাহী পিস ফ্যাসিলেটিটর গ্রুপের সমন্বয়কারী সাইফুল ইসলাম বাদশা বলেন, শুধু নামেই এগুলো খেজুরের গুড়। চিনি, আটা, কাপড়ের রং, চুন ও ফিটকিরি দিয়ে এসব গুড় তৈরি হচ্ছে। এ অঞ্চলের ঐতিহ্য রক্ষায় গতবছর থেকে আমরা ভেজাল গুড় তৈরি বন্ধে আন্দোলন শুরু করেছি। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনের আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রাজশাহীর সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, ভেজাল গুড় তৈরি বন্ধে আমরা চারঘাট-বাঘা ও পুঠিয়া এলাকায় অনেকগুলো পরিচালনা করেছি। এখন বেশিরভাগ কারখানায় দিনের পরিবর্তে রাতের আঁধারে ভেজাল গুড় তৈরি হচ্ছে। এজন্য আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে সমস্যা হচ্ছে। তারপরও সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা তাৎক্ষণিক সেখানে অভিযান পরিচালনা করছি।