বিলুপ্তির পথে বগুড়ার শাওইলের তাঁতপল্লি

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

শীতের আগ থেকেই বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ২৫ গ্রামের তাঁতপল্লিতে শুরু হয় কম্বল বোনার কাজ। খটর-খটর শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে গ্রাম। চরকাতে অবিরাম ঘুরতে থাকে উলের সুতা। কম্বল ছাড়াও বিছানার চাদর থেকে শুরু করে লুঙ্গি, গামছাও তৈরি হয় এই গ্রামে। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ও ঘরে বসানো পরিপাটি তাঁতযন্ত্রগুলো চলছে দিন-রাত। সব বাড়িতেই রয়েছে ১ থেকে ১০টি তাঁত। কোনোটা চাকাওয়ালা আবার কোনোটা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে হাতে তৈরি। শীত শুরুর আগে থেকেই সেই কম্বল বোনা শুরু হয়। শুধু শাওইল নয় দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, দেলিঞ্জা, পুশিন্দা, দেওড়া, দত্তবাড়ীয়া, বিনাহালী, কেশরতাসহ আশপাশের প্রায় ২৫ গ্রামের চিত্র একই। চরকার সঙ্গে এই গ্রামের মানুষের ভাগ্যও যেন ঘুরতে থাকে। তবে সুতা ও আনুসাঙ্গিক জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় লাভ নেই বললেই চলে এ শিল্পে। দিনে দিনে বিলুপ্তের পথে শাওইলের তাঁত শিল্প। স্থানীয়রা জানান, দেশের তাঁতশিল্পে বড় অবদান বগুড়ার শাওইল গ্রাম ও তার আশপাশের তাঁতিদের। উত্তরবঙ্গের এই তাঁতিগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে রেখেছে তাঁতের ঐতিহ্য। শীতের সময় এই গ্রামের মানুষের ব্যস্ততা বাড়ে কয়েক গুণ। সরেজমিনে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম শাওইলে প্রবেশ করতেই কানে আসবে তাঁতের খটর-খটর শব্দ। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ব্যস্ত সময় পার করেন। এছাড়াও সারা বছর চলে কম-বেশি তাঁতের কাজ। গ্রামে নারী-পুরুষ হতে শুরু করে শিশুদেরও দেখা যায় কেউ গার্মেন্টসের ছাট কাপড় থেকে সুতা তুলছেন, কেউ চরকা নিয়ে বসে সুতা নলি বা সূচিতে ওঠাচ্ছেন, কেউ বা সুতা ববিন করছেন। শাওইল গ্রামসহ এখানকার ২৫ গ্রামে রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার। এ শিল্পের ওপর জীবিকানির্ভর করে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের। শীতে এসব গ্রামের তৈরি হওয়া কম্বল, চাদর, লুঙ্গি, গামছা বিক্রির জন্য এখানে গড়ে উঠেছে একটি হাট। সেই হাট শুরু হয় ভোর ৪টা থেকে, চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। হাটে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীদের পদচারণে এসময় মুখরিত হয়ে উঠে হাট ও গ্রামটির পথঘাট। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের মধ্যে চলে চাদর, কম্বল আর সুতা কেনার হিড়িক। অনেকে এই হাটটিকে বলেন কম্বলের হাট। সরেজমিন দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব মোজাহার আকন্দ মেশিনের নিচের অংশে দু’পা দিয়ে পরিচালনা করছে। ওপরে ঝোলানো দাঁড়ির মাথার নিচ প্রান্ত ধরে টানাটানিতে সচল একহাত। আরেক হাত দিয়ে সুতার কাঠি ‘আকু’ (স্থানীয় ভাষায়) মেশিনের এপাশ-ওপাশ করছেন। দিনে তাঁত মেশিনে ব্যস্ত থাকেন তিনি। এভাবে একটা সময় পর মেশিন থেকে বেরিয়ে আসছে রং-বেরংয়ের বাহারি ডিজাইনের কম্বল। মোজাহারের মতো আমেনা নামের এক গৃহবধূ চরকায় সুতা কাটছেন। আমেনা বলেন, দিনে তিনি সংসারের কাজের পাশাপাশি ৮ থেকে ১০টা কম্বল তৈরি করতে পারেন। কিন্তু যত পরিশ্রম করেন সে হিসেবে লাভের মুখ দেখেন না। জীবিকার তাগিদে এই পেশাকে ধরে রেখেছে তারা। কম্বল ছাড়াও তোয়ালে, চাদর, গামছাসহ বিভিন্ন ধরনের তাঁতের বস্ত্র তৈরি হয় এই গ্রামে। আমেনা বলেন, এই গ্রামের মানুষের ভাগ্য যেন ঘোরে এই চরকার চাকায়। আগে সুতার দাম কম ছিল, আমাদের লাভ হতো ভালো। এখন সুতার দাম বেশি হওয়ায় লাভ নেই বললেই চলে। বিলুপ্তের পথে এই গ্রামের তাঁত শিল্প। একটি কম্বল তৈরি করতে সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। আগে যে সুতার দাম ছিল ৪০ টাকা কেজি এখন সেই সুতা ৬০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। কম্বল পাইকারি বিক্রি করি ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। আমেনা আরও বলেন, একটা কম্বল তৈরিতে যে পরিশ্রম হয় সে অনুযায়ী আমরা মূল্য পাই না। শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন জানান, শাওইলের চাদর আর কম্বল গ্রামগুলো ঘিরে হাজারও সম্ভাবনা থাকলেও সেভাবে বিষয়টি দেখা হচ্ছে না। তাঁতিদের সরকারি সুবিধা দিলে এটি হতে পারত রপ্তানির অন্যতম ক্ষেত্র। সুযোগ-সুবিধা না থাকার বিষয়ে তিনি জানান, আদমদীঘি থেকে এই বাজারের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। এখানে কোনো ব্যাংক নেই। অর্থ লেনদেনের জন্য তাই যেতে হয় আদমদীঘি ও মুরইলে। শাওইল হাটের মতো ব্যবসাকেন্দ্রিক স্থানে ব্যাংক না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক।