টাঙ্গাইলে বিষটোপ দিয়ে বাড়ছে অতিথি পাখি শিকার

কলকাকলিতে মুখর বিল-ঝিল দেশি-বিদেশি পাখি নিরাপত্তাহীন শিকারিদের লাগাম টানা জরুরি

প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের চারান বিল, চাপড়া, মলাদহ, ঝাইতলা, বরকম, পুঁইটা, নেধার বিলসহ বিভিন্ন খাল-বিল জলাধারে এখন অতিথি পাখির কলকাকলীতে মুখর। দেশি-বিদেশি পাখির কিচিরমিচির ডাক ও ঝাঁক বেঁধে আকাশে ওড়ার বিমোহিত দৃশ্য দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। জেলার খাল-বিল ও জলাশয়ে এ অপরূপ দৃশ্য অবলোকনে প্রকৃতিপ্রেমিদের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু বেরসিক শিকারিরা বিশেষ কায়দায় ‘বিষটোপ’ ব্যবহার সহ নানাভাবে এসব পাখি শিকারে মত্ত হওয়ায় পাখিরা নিরাপত্তহীনতায় পড়েছে। জানা যায়, শীতকালে উষ্ণতার খোঁজে শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের জলাধারগুলোকে নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয় পরিযায়ী পাখি। সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিলগুলো যেন শীতের অতিথিদের বরণ করে নিতে বাৎসরিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। জেলার বিলগুলোতে প্রতিবছরের মতো এবারও এসেছে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। নিত্যদিন ভোরের কুয়াশার আঁচল চিরে দলবেঁধে উড়ে চলা পাখির ডানার শো-শো শব্দ আর কলতানে ঘুম ভাঙে খাল-বিল ও জলাধারের বাসিন্দাদের। এবারও বিলের কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদের মাঝে খোলা পানিতে জলকেলিতে মেতে উঠেছে পাখিরা। একটু থেমেই একঝাঁক পাখি পানিতে অবতরণ করছে তো আর একঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। এ যেন তাদের আপন নীড়ে উৎসব। জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার চর নিকলা বিল, কয়েড়া ধোপাচড়া বিল, আমুলা বিল, বর্ণিবিল, বার্থাবিল, বালিয়া বিল, নিরাইল বিল, চারান বিল, দোগাঙ্গীবিল, মলাদহবিল, ঝাইতলাবিল, বরকমবিল, পুঁইটাবিল, ধোপারকমবিল, খৈইলাকুড়িবিল, আদমবুইড়াবিল বিভিন্ন খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমিতে শীত মৌসুমে দেশি পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখি এসে যোগ দেয়। দিনভর পাখিগুলো ছোট ছোট মাছ ও জলজপ্রাণী নানা ভঙিমায় শিকার করে খায়, কিচিরমিচির কলকাকলীতে মেতে ওঠে এবং মাঝেমাঝেই ঝাঁক বেঁধে জলাশয়ের পাশে ওড়ে বেড়ায়। বিমোহিত এ দৃশ্য অবলোকনে প্রকৃতিপ্রেমীরাও ভোর থেকে বিকাল পর্র্যন্ত জলাধারে বেড়াতে আসে। তবে একশ্রেণির শিকারি অভিনব কায়দার ‘বিষটোপ’ সহ নানা ফাঁদে ফেলে এসব পাখি শিকারে মত্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ এসব পাখি শিকার করে স্থানীয় মাংশাসীদের কাছে চড়াদামে বিক্রি করছে। ফলে জেলার খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমিগুলোতে প্রতিবছর পরিযায়ী পাখির বিচরণ কমছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুষ্ট শিকারিরা ছোট মাছের পেটে বাসুডিন, ফুরাডান ও কার্বোটাফ নামে এক ধরনের বিষ ঢুকিয়ে খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমির পাশে বা খোলা মাঠে ছিটিয়ে রাখা হয়। এটাকেই ‘বিষটোপ’ বলা হয়। এসব বিষ মেশানো মাছ খেয়ে দেশি-বিদেশি পাখিগুলো অচেতন হয়ে পড়ে। শিকারিরা সেগুলো ধরে নিয়ে হাটবাজার ও স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দেয়। এছাড়া পুঁটি মাছের পেটে বিষ দিয়েও নির্বিচারে বক পাখি শিকার করা হয়। মূলত: খাওয়ার জন্যই বক পাখি শিকার করা হয়ে থাকে। বিষটোপ খেয়ে বক ও অতিথি পাখিরা অচেতন হয়ে পড়লে শিকারিরা দৌড়ে গিয়ে ধরে সঙ্গে সঙ্গে জবাই করেন। পরিবেশবিদরা মনে করেন, এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে ক্রমান্বয়ে পাখির বিচরণ কমে যাবে- যা পরিবেশের ভারাসাম্য বিনষ্ট করবে। মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. সুজাউদ্দিন তালুকদার জানান, পাখি শিকারের জন্য যে বিষটি ব্যবহার করা হয় তা ওপিসি জাতীয় বা গণ ফসফরাস কমপাউন্ড জাতীয় এক ধরনের বিষ। এটা কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটা মানুষের দেহে সবদিক দিয়েই ঢুকতে পারে- স্কীনের উপর দিয়ে ঢুকতে পারে, খাবারের মাধ্যমে এবং শ্বাসনালীর মাধ্যমেও ঢুকতে পারে এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে এটা স্কীনের উপরে থাকলে রক্তের সাথে মিশে যেতে পারে। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইএসআরএম) বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে- শুধুমাত্র মধুপুর জাতীয় উদ্যানে ১৪০ প্রজাতির পাখির উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার অনেক বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদশে রয়েছে বাহারি ধরনের বক পাখি এবং এদের অনেক প্রজাতি টাঙ্গাইল অঞ্চলে দেখা যায়। টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান জানান, যেসব এলাকায় পাখি শিকার করা হচ্ছে সে অঞ্চলে বনাঞ্চল না থাকায় তাদের তেমন একটা নজরে আসে না। তাছাড়া তাদের জনবল খুব কম থাকায় যথা সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। তবে যারা পাখি শিকার করে অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।