ঢাকা ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হারিয়ে যাচ্ছে হাতে লেখা ও রংতুলির কাজ

হারিয়ে যাচ্ছে হাতে লেখা ও রংতুলির কাজ

রং আর তুলির ছোঁয়ায় নতুন এক শিল্পের জন্ম দেন শিল্পীরা। রংতুলির খেলার মাঝে খুঁজে নেন নিজের আনন্দ। নিজ এবং পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বটাও তুলে দেন এই রংতুলির হাতেই। এভাবেই জীবন চলে চারু শিল্পীদের। তবে শিল্পে প্রযুক্তির ছোঁয়া পাল্টে দিচ্ছে এসব শিল্পীদের জীবনযাত্রা। আগে জাতীয় বা স্থানীয় নিবার্চনে ব্যানার ফেস্টুন, সিনেমার পোস্টার তৈরি নিয়ে যারা অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করতেন আজ তারাই কাজের অভাবে নিজ পেশা ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ঝালকাঠি জেলায় বর্তমানে কয়েকজন নামে মাত্র টিকে আছেন। শহরে চলতে গেলে আগে বাসের গায়ে, ট্রাকের গায়ে, রিকশার গায়ে, ট্রাক, বিলবোর্ড কিংবা দেয়ালের গায়ে শিল্পীর হাতে আঁকা মনের মাধুরি মেশানো হরেক রকম ছবি চোখে পড়ত। সিনেমা হলগুলোর সামনে সিনেমার দৃশ্য আঁকা হতো শিল্পীর রং তুলিতে। বিভিন্ন সভা সমাবেশে কাপড়ের ওপর হাতের লেখা সেই নিপুণ ব্যানার এখন অতীত হয়ে গেছে। ঝালকাঠি জেলায় একসময় রংতুলির আঁচড়ে ব্যানার বা সাইনবোর্ড লিখে জীবিকা নির্বাহ করতেন প্রায় অর্ধশতাধিকের বেশি শৌখিন বা পেশাজীবী শিল্পীরা। আধুনিক যুগে ডিজিটাল নির্ভর কর্মক্ষেত্রে সাইনবোর্ড বা ব্যানার লিখন কাজের ব্যাপক চাহিদায় কদর কমেছে মূলধারার চারু শিল্পীদের। এক সময় যাদের রংতুলির আঁচড়ে নানা ধরনের ব্যানারের লেখা শোভা পেত শহরের সড়কের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড থেকে শুরু দেয়ালিকায় শোভা পেত রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা তারা আজ হারিয়ে যেতে বসেছেন। এসব স্থানে তাকালে এখন আর দেখা মেলে না এসব শিল্পের। যান্ত্রিকতার এই যুগে হারিয়ে যাচ্ছে রং আর তুলির কারুকাজ ও শিল্পীরা। এখন অল্প টাকায় স্বল্প সময়ে প্যানাপ্লেক্সের (ফেস্টুন) তৈরি বিভিন্ন ধরনে ব্যানার পাওয়া যাচ্ছে। আবার ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছেন ডিজিটাল ব্যানারে দিকে। শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামেও ডিজিটাল ব্যানার প্রসার লাভ করেছে। তাই জীবিকা নির্বাহের প্রতিযোগিতায় রং-তুলি ছেড়ে শিল্পীরা ঝুঁকে পড়ছেন অন্য পেশায়। তারপরও যারা এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন তারাও ভালো অবস্থানে নেই। দেয়ালে কাপড় টানিয়ে ব্যানার লিখন, লঞ্চ স্টিমারে ও প্রতিষ্ঠানে দেয়াল লিখন কাজের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল ব্যানার। ঝালকাঠির রাজাপুর সদরের বিশ্বাস বাড়ি এলাকার অঞ্জন মিস্ত্রি। উচ্চ শিক্ষিত হাসিখুশি একজন মানুষ। পরিবারের ছয়জনের মধ্যে তিনি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকেই তার শিল্পী মন নিয়ে বেড়ে ওঠা। মঞ্চ অভিনয় আর আর্টের ওপরে ছিল তার খুবই দুর্বলতা। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নিয়েছেন প্রশিক্ষণ।

একসময় সংসারের ভার তার কাঁধে পড়তেই শখের বসে করা শিল্পটাকেই নিয়ে নিলেন পেশা হিসেবে। এরপর তিনি রাজাপুর উপজেলার ডাকবাংলো মোড়ের ভাড়ার দোকানে দীর্ঘ ২৭ বছরের বেশি সময় ধরে এই শিল্পকে সঙ্গী করে চলেছেন। একটা সময় তিনি নিজ উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও ব্যানার, সাইনবোর্ড, ফেস্টুন লেখা, ছবি আঁকা, বাঁধাই, ওয়ালমেট বাঁধাইসহ বিভিন্ন কাজ করেছেন তার রং-তুলি ছোঁয়ায়। তার ছোট টিনের ঘরটিতে সর্বদা মানুষের ভিড় লেগে থাকত। তিনি হাসিমুখে রং-তুলির মিলনে কাপড়, কাঠ, টিনের বুকে, দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তুলতেন গ্রাহকের মনের ভাষা। শিল্পি ইউনুচ আলী হাওলাদার বলেন, আমি নলছিটিতে অনেক আগ থেকেই আর্ট পেশার সাথে জড়িত। মূলত বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড ও ব্যানার লিখতাম। তবে এখন কাজের সংখ্যা খুবই কম এখন সবাই ১০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে একটা প্যানাপ্লেক্সের ব্যানার লিখে এনে সহজেই দোকানের সামনে সাঁটিয়ে দিচ্ছেন। ঠিক একই কাজ আমাদের দিয়ে করাতে রং ও মজুরিসহ কম করে হলেও ১ হাজার টাকা দিতে হবে। তাই অনেকেই খরচ ও সময় বাঁচানোর জন্য আমাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন না। যদিও আমাদের রং দিয়ে তৈরি কাজের স্থায়িত্ব অনেক বেশি ও পরিবেশবান্ধব। আর প্যানাপ্লেক্সের তৈরি সাইনবোর্ড ও ব্যানারে যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হয়, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এর স্থায়িত্বও তুলনামূলক কম। সবমিলিয়ে আমাদের আর্ট শিল্পিদের খারাপ সময় যাচ্ছে। তাই এই পেশার সাথে জড়িত মানুষের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক কর্মী মাইনুল ইসলাম সুজন বলেন, রং-তুলির শিল্পীরা বাঙালি ঐহিত্যের ধারক ও বাহক। বর্তমানে তারা এই পেশায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। তারা শুধু ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি না বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালির কৃষ্টি কালচারকেও রং-তুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন। প্যানাপ্লেক্স দিয়ে যেসব জিনিস তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরও বটে। তাই সরকারের উচিত এসব শিল্পীদের টিকিয়ে রাখতে প্যানাপ্লেক্সের তৈরি ব্যানার ফেস্টুনের ব্যবহার সীমিত করা বা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেওয়া। ঝালকাঠির সামাজিক সংগঠন ইয়ুথ অ্যাকশন সোসাইটির (ইয়াস) সাংগঠনিক সম্পাদক সাব্বির হোসেন রানা বলেন, একটা সময় বিভিন্ন সভা সমাবেশে চারু শিল্পীদের হাতে লেখা ব্যানার ব্যবহার করতেন মানুষ। এখন আর তাদের দিয়ে কেউ লেখালেখির কাজ করাতে চান না। তাই তাদের এখন দুর্দিন যাচ্ছে। তাদের নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত