অবৈধ চারকোল কারখানায় পরিবেশ বিপর্যয়

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নানা বয়সি মানুষ

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদওহাবপুর ইউনিয়নের দর্পনারায়ণপুর গ্রামে আবাসিক এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে চারকোল কারখানা (পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন তৈরির কারখানা)। ছাই ও কালো ধোঁয়ায় মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর। শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধসহ নানা বয়সি মানুষ। একই কারণে কমছে ফসলি জমির উৎপাদনও। প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদওহাবপুর ইউনিয়নের দর্পনারায়ণপুর গ্রামে দৌলতদিয়া-কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে চারকোল কারখানা। এ কারখানায় পাটকাঠির ছাই থেকে তৈরি করা কার্বন চীনে রপ্তানি করা হয়। যা চীনে মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ, কার্বন পেপার, ফটোকপির কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশ ও প্রসাধন তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকলেও বছরের পর বছর ধরে অবাধে চলছে কারখানাটি। ছাই ও কালো ধোঁয়ায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ নানা বয়সি মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। কারখানায় দুবার বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও নেয়া হয়নি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। জানা গেছে, এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিনে আনা হয় পাটকাঠি। এরপর সেগুলো বিশেষ চুল্লিতে লোড করে আগুন জ্বালানো হয়। ১০-১২ ঘণ্টা জ্বালানোর পর চুল্লির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে কোনোভাবে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে চার দিন রাখার পর সেখান থেকে বের করে ভেঙে কার্বন প্যাক করা হয়। চুল্লি জ্বালানোর সময় কারখানা থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হয়। এই ধোঁয়াতেই মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষিত হয়। স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম বলেন, এর আগে এ চারকোল কারখানায় দুইবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সবশেষ ২০২৩ সালের ২ এপ্রিল সন্ধ্যায় কারখানার কেমিক্যাল বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লাগে। আগুনের সূত্রপাত হলে আশপাশের বাড়িঘরের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ছয় ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে ২৮ দিন পর্যন্ত সেই আগুনের শিখা ছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন এ কারখানার নাম ছিল বাংলাদেশ চারকোল লিমিটেড। তবে হঠাৎ করেই কারখানার নাম বদলে গত ২ ফেব্রুয়ারি কারখানাটি আবার চালু করে। এখন এর নাম দেওয়া হয়েছে ইয়াং বাংলা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেড।

তবে মালিক একজনই আছেন। তিনি বলেন, এলাকাবাসী বর্তমানে খুব আতঙ্কের মধ্যে আছেন। এ চারকোল কারখানায় আবারও যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ আগুন লেগে মানুষের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। কারখানা বন্ধের জন্য আমরা জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে বার বার লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরেও অদৃশ্য কারণে এর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আমরা এ অবৈধ চারকোল কারখানা বন্ধের দাবি জানাই। দর্পনারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা কুতুব উদ্দিন বলেন, কার্বন তৈরির এ কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় আশপাশের আকাশ কালো হয়ে যায়। খাবারের ভেতরে গিয়ে কালি পড়ে। বিছানায় কালি পড়ে বিছানা নষ্ট হয়ে যায়। ধোঁয়ার কারণে রাতে ঘরে থাকা যায় না। ঘরে থাকলেও চোখ জ্বলে। বাচ্চারা ঘুমাতে পারে না। দূষিত ধোঁয়ার কারণে শিশু ও বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষের শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। একই গ্রামের ইমরান হোসেন বলেন, ধোঁয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থ বাতাসের সঙ্গে মিশে গাছপালায় লাগে। এতে এলাকার গাছপালায় কোনো ফল হয় না। আমের মৌসুমেও গাছে মুকুলের দেখা পাওয়া যায় না। রাতে ঘরে শুয়ে থাকলে সকালে কাশির সঙ্গে ছাই বের হয়। মামুনুর রশীদ বলেন, এ কারখানার কারণে আশপাশের এলাকার ফসলি জমিরও উৎপাদন কমে গেছে। কৃষকরা জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেও ফলন বাড়তে পারছেন না। তাই দ্রুত এ কারখানাটি এখান থেকে অপসারণ করার দাবি জানাই। রাজবাড়ী সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. রহমত আলী বলেন, চারকোল কারখানা থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তাতে অতিরিক্ত পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত হওয়ায় এর মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ থাকে। এ কারণে এ ধোঁয়া ছোট-বড় সব বয়সি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। এ থেকে মানুষের শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমা হতে পারে। ক্রনিক ব্রংকাইটিস ডিজিজ হতে পারে। এমনকি অনেক দিন এই ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকলে মানুষের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার চর্ম রোগ ও কোষ্টকাঠিন্য রোগও দেখা দিতে পারে। রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জনি খান বলেন, চারকোল কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি আশেপাশের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে আশপাশের মাঠের ফসল ও ফল গাছের পরাগায়ন শুকিয়ে যায় এবং ব্যাহত হয়। এছাড়া ফসলের জন্য উপকারী যেসব পতঙ্গ বিশেষ করে মৌমাছি সেগুলো এই এলাকাতে থাকে না। সেজন্য ব্যাপক আকারে পরাগায়নের অভাবে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোভন রাংসা বলেন, এ চারকোল কারখানার বিষয়ে স্থানীয়রা জেলা প্রশাসক ও আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চারকোল কারখানার মালিক আতিকুর রহমানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কারখানা পরিবেশবান্ধব। আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও রয়েছে। তবে সেটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। দ্রুত আমরা মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করব।