ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প

সেচ সুবিধা থেকে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমি বঞ্চিত

* আওতাভুক্ত চাষিরা প্রতি বিঘা জমিতে মাত্র ১৮০ টাকায় পাচ্ছেন সেচ সুবিধা
সেচ সুবিধা থেকে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমি বঞ্চিত

পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আইআরডি) দেশের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন সেচ প্রকল্প বিভিন্ন ক্রটির কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছে প্রকল্পের বেশীরভাগ এলাকা। ফলে ভেস্তে গেছে প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ প্রকল্পভুক্ত চাষিরা তিনটি ফসলে প্রতিবিঘা জমিতে মাত্র ১৮০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিয়ে সেচ সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রকল্পটির অবকাঠামোগত ক্রটির কারণে ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি সেচের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে বোরো মৌসুমে প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ার হাজার হাজার কৃষক গভীর-অগভীর নলকূপ বসিয়ে জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে ফসল উৎপাদন খরচ যেমন অনেক বেড়ে যাচ্ছে তেমনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আইআরডি) দেশের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন সেচ প্রকল্প ১৯৮৩-৮৪ সালে ২ হাজার ৯৫৪ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে বণ্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দৈর্ঘ্য ১৫৭.৫৫ কিলোমিটার বেড়া ও কৈটলা দুটি পাম্পিং স্টেশন, প্রধান সেচ ক্যানেল বেড়া টু সাঁথিয়ার মাধপুর পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার, ১৯টি সেকেন্ডারী ক্যানেল প্রায় ২১২ কিলোমিটার, ৪৭টি টারশিয়ারী নিষ্কাশন ক্যানেল ১৪৫ কিলোমিটার ও চার শতাধিক মাইনর ক্যানেলসহ পানি সংরক্ষন ক্যানেলের মুখে ২৩টি স্লুইচগেট নির্মাণ করা হয়।

জানা গেছে, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এ সেচ প্রকল্পটি ১৩ হাজার ২৮১ হেক্টর জমি সেচের আওতায় এনে বছরে অতিরিক্ত ১ লাখ ৯১ হাজার টন ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১৯৯২ সালে সেচ প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। অথচ এতে সেচ সুবিধা পাচ্ছে মাত্র এক হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে। সেচ প্রকল্পের অবশিষ্ট প্রায় ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি আজ পর্যন্ত সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কারণ, হিসেবে জানা গেছে অবকাঠামোগত ক্রটি থাকায় গত ৩২ বছরে কৃষকদের কাঙ্ক্ষিত সেচ সুবিধা দিতে পারছে না এ প্রকল্পটি।

প্রকল্প এলাকায় সেচ সুবিধাভোগী চাষিরা জানান, তিনটি ফসল আবাদের জন্য বিঘা প্রতি বছরে ১৮০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। এতে প্রকল্পের সেচ সুবিধাপ্রাপ্ত কৃষকদের ফসল উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। এতে লাভবান হচ্ছে অল্পসংখ্যাক কৃষক। অন্যদিকে সেচ সুবিধা বঞ্চিত কৃষকরা জানান, শুধুমাত্র বোরো উৎপাদনে সেচ বাবদ ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

 প্রকল্প এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কমান্ড এরিয়াভুক্ত সাঁথিয়া উপজেলার বোয়াইলমাড়ি গাগড়াখালী, ছেচানিয়া, পানিশাইল, বায়া, বড়গ্রাম, বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ, হরিরামপুর, কৈটোলা, নতুন পেঁচাকোলা, মাছখালিসহ বেশ কিছু গ্রাম ঘুরে দেখা যায় বর্তমানে সচল ক্যানেলগুলো যথাযথভাবে সংস্কার না করায় অকার্যকর হয়ে পড়ছে। অনেক এলাকায় সেচ ক্যানেল মাটির সাথে মিশে গেছে। অনেকে আবার ক্যানেল ভরাট করে দোকানপাট গড়ে তুলেছে। সম্প্রতি বেড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু কিছু এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করেছে।

অভিযোগ রয়েছে প্রতিবছর ক্যানেল সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে থোক বরাদ্দের কোটি কোটি ব্যয় করা হয়, এতে সংশ্লিষ্টদের পকেটভারী হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। চলতি বছরেও দুই কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। অথচ গত ৩২ বছরে প্রকল্পের একটি সেকেন্ডারি, ৩০টি টারসিয়ারী ও ২ শতাধিক মাইনর ক্যানেলে পানির প্রবাহ ঘটানো সম্ভাব হয়নি বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে তারা প্রকল্পের সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।

কৃষক রমজান বলেন, আমার ৫ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করি। এই ক্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একদিন পর পর ৫ লিটার করে তেল লাগে। এরপর ১ হাজার ৫০০ টাকা মেশিন ভাড়া দিয়ে আমাদের আর কিছু থাকে না। তিনি বলেন, আপনাদের মাধ্যমে সরকারকে জানাতে চাই আমাদের ক্যানেলগুলো সচল করে দিলে আমরা আগের মতো অল্প খরচে আবাদ করে লাভবান হতে পারব।

পানি ব্যবহারকারি সমিতির সভাপতি আনছার আলী জানান, প্রকল্পের সেচ সুবিধাভোগী চাষিদের তিনটি ফসল আবাদের জন্য বিঘাপ্রতি বছরে ১৮০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। এতে প্রকল্পের সেচ সুবিধাপ্রাপ্ত কৃষকদের ফসল উৎপাদন খরচ অনেক কম পড়ছে। অন্যদিকে সেচ সুবিধা বঞ্চিত কৃষকদের শুধুমাত্র বোরো ফসল উৎপাদনে বিঘাপ্রতি সেচ বাবদ প্রায় ৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাগেছে ১৯৯২ সাল থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত সেচ ক্যানেলের ডাইক মজমুতকরণ, সম্প্রসারণ, সেচ ক্যানেল সংস্কার বাবদ এডিবি এবং জিওবি খাত থেকে প্রায় সাড়ে ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সূত্রটি দাবি করেছে, সরকারি এ বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় বেশির ভাগই লোক দেখানো নামমাত্র কাজ করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর ফলে গত ৩২ বছরে প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ায় সেচ লক্ষ্যমাত্রার সিকি ভাগ জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় সেচের জমি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮০০ হেক্টর।

বেড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী জানান, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন (আইআরডি) ইরিগেশন প্রজেক্টটি গেল ২৪ বছর ধরে যতটুকু পারছি ক্যানালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করছি তবে কিছু কিছু সমস্যার কারণে ক্যানালগুলো হয়তো পুরোপুরি সেচ দিতে পারছিনা তবে প্রকল্পটির অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ও সংস্কার সাধন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এটা চালু হলেই সেচ প্রকল্পের আওতায় শুধু ১৩ হাজার নয়, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত