আধুনিকতার ছোঁয়ায় অস্তিত্ব সংকটে কামারশিল্প

প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া পৌর শহরের কামারপাড়ায় গেলেই কানে আসে লোহা পেটানোর টাং টুং শব্দ। কাঠ কয়লার আগুনে উত্তপ্ত লোহায় আঘাত করে চলছে বিভিন্ন লোকজন। তারা গ্রামীণ ও নগর জীবনে ধরে রেখেছে অর্থনীতির অন্যতম বলয়। বংশ পরম্পরায় চলে আসা এক সময়ের ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এ পেশাকে ধরে রেখে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, অনেক কর্মকার তারা সেখানে লোহা পিটানো, গলানো, ধারালো করা, আল কাঁটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ করছেন। কয়লা প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে একটি মাল তৈরি করে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সবাই আলাদা আলাদাভাবে কাজ করেন।

চিত্তরঞ্জন কর্মকার জানান, বাবা কার্তিক কর্মকারের হাত দিয়ে শুরু হয় এই কামার পেশা। সংসারের অভাবের কারণে বাবার সঙ্গে হাতেখড়ি হয় এই পেশার। বাবার দশ বিঘা জমি মানুষ নিয়ে যাওয়ার পরে সংসারে নেমে আসে অসচ্ছলতা। চাহিদার কারণে বাবার সঙ্গে রেখেছিলেন। ধীরে ধীরে এই কামার পেশাকে স্থায়ীভাবে বেছে নেন। বাবার থেকে কাজ শিখে প্রজন্মের মানুষ হিসেবে এ পেশায় আছেন তিনি। মঠবাড়িয়া বাজারে এখন মোট ৮টি কামার ঘর আছে; কিন্তু আগে আরো বেশি ছিল। সবচেয়ে পুরোনো এবং কাস্টমারদের কাছে বিশ্বস্ততা ধরে রেখে কর্মকাররা ব্যবসা করে আসছেন যুগের পর যুগ ধরে। তবে এই পেশায় এখন আর ভালো নেই তারা। এ পেশার সঙ্গে জড়িত রবিন কর্মকার আক্ষেপ করে বলেন, বছরের পর বছর এ শিল্প নিয়ে কাজ করলেও তারা কোনো ব্যাংকঋণ-সুবিধা পান না। সব সময় তাদের ঋণ লাগে না।

কিন্তু যখন ঋণ প্রয়োজন হয়, তখন চড়া সুদে এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়। আর সে ঋণ পরিশোধ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। সুশীল কর্মকারের দোকানে বসে কারিগর শেখর কর্মকারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ১২ বছর বয়সে তিনি বাবা সঙ্গে লোহা পেটানোর জন্য হাতে হাতুড়ি তুলে নেন। তার কাজ করতে গিয়ে দু’হাতে দুটি আঙুল হারিয়ে ফেলেন। তারপরেও অভাবের সংসারে এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তিনি প্রথমে গরম লোহা পেটানোর কাজ করতেন। কয়েক দিন সেই কাজ করার পর তাকে দেওয়া হয় লোহা গলানোর কাজ। ধীরে ধীরে কাঁচা লোহা গরম করা, সেটা থেকে মালামাল বানানোর কাঠামো তৈরি, তারপর গৃহস্থালি বঁটি, খুন্তি, পাছুন, কৃষকের কাস্তে, নিড়ানি, খুন্তি, কোদাল, লাঙলের ফলা, শ্রমিকের কুঠার, শাবল, দা, বড় চাকু (দা, ছোরা বেশি ব্যবহার করে মাংস ব্যবসায়ী কসাইরা) ইত্যাদি তৈরি করা, ফিনিশিং দেওয়া, ধারালো করা ও সবার শেষে বিক্রি জন্য উপযুক্ত একটি মাল তৈরি করা।

এই কয়েকটি ধাপ জানলেই কামারী হিসেবে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ কারিগর তৈরি করতে পারেন যে কোনো ব্যক্তি। তবে এই কাজগুলো শেখার জন্য সবার আগে দরকার ইচ্ছে শক্তি ও মনোবল। পরের প্রজন্ম এ পেশায় আসবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, তিন পুরুষ ধরে আমরা এই কাজ করতেছি। আমার ছেলে মাস্টার্স পাস করেছেন। আমার পরিবারের কোনো সদস্যকে এই পেশায় নিয়ে আসার ইচ্ছা নেই। আমাদের দোকানের বয়স ৭০ বছর; কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের পুঁজি বলতে কিছুই নেই। দিন এনে দিন খেয়েই কেটে যাচ্ছে আমাদের জীবন। আমি চাই না ও কোনোভাবে এই পেশায় আসুক। আমি ওকে পড়াশোনা করাচ্ছি যাতে ভালো কিছু করে। এখানে যেন না আসে। এই পেশায় আসলে শরীরকে আগুনের তাপে পুড়িয়ে লোহার মতো করে ফেলতে হয়। আমি চাই না আমার ছেলের শরীর আমার মতো পুড়ে লোহা হয়ে যাক। তবে তারা মনে করছেন কালের পরিবর্তনে একটি সময় হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এই ঐতিহ্যবাহী পেশা। কারণ আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন এই শিল্প প্রয়োজন কমে যাচ্ছে মানুষের কাছে।