ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে মুঘল আমলের মসজিদ

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে মুঘল আমলের মসজিদ

নীলফামারী জেলার যেসব স্থাপত্যশৈলী এখনো মানুষকে আকর্ষিত করে তার মধ্যে অন্যতম হলো মুঘল আমলের মসজিদগুলো। এসব মসজিদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এর মধ্যে জেলা শহরের কেন্দ্রীয় বড় মসজিদ, সদর উপজেলার কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের আঙ্গারপাড়া বড়বাড়ি জামে মসজিদ, কিশোরগঞ্জ উপজেলার চাঁদ খোশাল মসজিদ বা চাঁদ খাঁ মসজিদ, জলঢাকা উপজেলার সিদ্দেশ্বরী তিন গম্বুজ মসজিদ, শেখপাড়া জামে মসজিদ ও সৈয়দপুরের চিনি মসজিদকে মুঘল সাম্রাজ্যের অবকাঠামো এবং আধুনিক স্থাপত্যশিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।

এগুলো মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক নির্দশন। কিন্তু কালের বিবর্তনে সংস্কারের অভাবে সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এসব স্থাপনাগুলো। এগুলো দ্রুত সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

নীলফামারী বড় মসজিদ : নীলফামারী পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মসজিদটি ঠিক কত বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে, তার সঠিক হিসেব ও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মুঘল শাসনামলের স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো থাকায় এটিকে মুঘল আমলের মসজিদ বলা হয়। নির্মাণশৈলীর কারণে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন মসজিদের মূল অংশের সামনে আছে পাঁচটি গম্বুজ। চারিদিকে চারটি এবং মাঝখানে একটি। গম্বুজের চারিদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চার মিনার। গম্বুজগুলো ইট, চুন ও সুরকি দিয়ে নির্মিত। এগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করতে ওপরে বসানো হয়েছে বাহারি রঙের চিনা মাটির টুকরো। কালের বিবর্তনে গম্বুজগুলোতে দেখা দিয়েছে ফাটল। চার মিনারের একটি ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। জেলা শহরের কেন্দ্রীয় বড় মসজিদের মুসল্লি শহরের প্রগতি পাড়ার মানিক বলেন, ‘মসজিদটি ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা নির্দিষ্ট ভাবে বলা মুশকিল। বাপ-দাদার আমল থেকে এই মসজিদটি দেখছি। তবে কিছু অংশে ফাটল দেখা দেওয়ায় ভয়ে ভয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। এটি সংস্কারের দাবি জানাই। সংস্কার না করলে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তখন এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি হারিয়ে যাবে।’

বড়বাড়ি জামে মসজিদ : স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনের পাশাপাশি এই মসজিদটি সাধারণ মানুষের কাছে রহস্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলফামারী পৌরসভা থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে এটি। কেউকেউ আঙ্গারপাড়া বড়বাড়ি মসজিদ নামে পরিচিত। এই মসজিদ কত সালে নির্মাণ হয়েছে, সেই সম্পর্কে কারও কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। তিন গন্বুজের মসজিদটিতে আছে আটটা মিনার। তিন ফুট দৈর্ঘ ও দুই ফুট প্রস্থের তিনটি দরজা ও মাঝের দরজার ওপরে পাথরে খোদাই করা আরবি বর্ণিত লেখা। মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রায় ২৪ বছর ধরে মসজিদের খেদমতে আছি। কিন্ত কারও মুখে শুনিনি এটা কে বা কত সালে তৈরি হয়েছে।’ আঙ্গারপাড়া বড়বাড়ি জামে মসজিদ মুসল্লি লুৎফর রহমান জানান, ‘নামফলক পড়ে দেখেছি, তাতে আরবি ৬১৬ হিজরি লেখা আছে মনে হয়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৮ ফুট ও প্রস্থ ৯ ফুট। ইটের পুরু ২ ইঞ্চি, লম্বায় ১০ ইঞ্চি। একটি নাম কোনো রকম বোঝা যায়, মাহমুদুল্লাহ হাসান। তিনি আরও বলেন, ‘মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন থাকায় এটিকে মুঘল আমলের মসজিদ বলা হয়। নামফলক হিসেবে মসজিদটির বয়স ৮০০ বছর তবে প্রাচীনতম মুসলিম সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এটি।’

চাঁদ খোসাল মসজিদ : কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের ভেড়ভেড়ি গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপত্যকলার আরেকটি নিদর্শন চাঁদ খোসাল মসজিদ। প্রায় ৫০০ বছর আগে নির্মিত বলে জানা যায়। সংস্কারের অভাবে মসজিদটার স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে মুঘল আমলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। স্থানীয় বাসিন্দা আবু সায়েম জানান, প্রায় ৫০০ বছর আগে ভেড়ভেড়ি গ্রামের তৎকালীন জমিদার সূর্য আলহাজ চৌধুরীর চাঁদ এবং খোসাল চৌধুরী নামে দুই ছেলে ছিলেন। চাঁদ চৌধুরী এবং খোসাল চৌধুরী মসজিদটি নির্মাণ করেন। সেই থেকে নামকরণ হয় চাঁদ খোসাল মসজিদ। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের অবকাঠামোর দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট, প্রস্থ ১০ ফুট এবং উচ্চতা ৫০ ফুট। তবে সংস্কারের অভাবে সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদ খোসাল মসজিদের। খাদেম আফান উদ্দিন বলেন, ‘চাঁদ এবং খোসাল দুই ভাইয়ের মধ্যে চাঁদ চৌধুরী নিঃসন্তান হওয়ায় উভয় ভাই তৎকালীন সময়ে মসজিদের জমি ওয়াকফ করেন। যার পরিমাণ মোট ১৪৭ একর। ওয়াকফ অনুযায়ী, মসজিদের অবকাঠামোর মধ্যে ২ একর ৫২ শতক জমি থাকলেও বর্তমানে ২৫৫ দাগে অবকাঠামো রয়েছে ১৩ শতাংশে এবং ৩৯৯ দাগে ২৮ শতাংশ জমিসহ (পুকুর) মসজিদের দখলে আছে মোট ৪১ শতাংশ। বাকি জমিগুলো অন্যদের দখলে। মসজিদটি সংস্কার করে জমিগুলো উদ্ধারের দাবি জানাই।’

তিন গম্বুজ মসজিদ : জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ীর সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে মুঘল আমলের তিন গম্বুজ এবং ১২ মিনার বিশিষ্ট মসজিদটি অবস্থিত। নীলফামারী সদর উপজেলা থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে এটি। দৈর্ঘ্য ১৫ হাত, প্রস্থ তিন হাত, তিনটি গম্বুজ ১৫ ফুট ও ১২টি মিনার ১৫ ফুট উঁচু। দেয়ালের ওপরের দিকে ফুল ও লতা গুল্মের ছবি আঁকা। দেয়ালে ইট, চুন ও সুরকির গাঁথুনি। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি দেখতে আসেন অনেক দর্শনার্থী। আকারে ছোট হলেও মুঘল সাম্রাজ্যের কারুকার্য খচিত নকশা ও গম্বুজগুলো অন্যরকম। দেয়ালে দরজার ওপরে আরবি হরফে কিছু লেখা আছে, তবে তা অস্পষ্ট। এলাকাবাসীর দাবি, এটি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব আমলে তৈরি মসজিদ। তবে সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এই স্থাপত্য।

শেখপাড়া জামে মসজিদ : অপূর্ব স্থাপত্যের নির্দশন হিসেবে পরিচিত মুঘল আমলের এই মসজিদটি। নীলফামারী সদর উপজেলার খোকশাবাড়ীর ছিট গোড়গ্রামে অবস্থিত। জানা যায়, ১৭৮৮-৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মোহাম্মদ জারিফ নির্মাণ করেছিলেন। এটির দৈর্ঘ্য ১৫ দশমিক ৮ মিটার ও প্রস্থ ছিল ৫ মিটার। সামনের দেয়ালে একটি শিলালিপি স্থাপিত আছে। শিলালিপিতে সাত সারির ফরাসি পঙ্ক্তিমালা লেখা। নীলফামারী থেকে আসা দর্শনার্থী আরিফ হোসেন ও মাফিজার রহমান জানান, মসজিদটি দেখতে অনেক সুন্দর। তাই দেখতে এলাম, নকশাগুলো অপূর্ব।

চিনা বা চিনি মসজিদ : সৈয়দপুরের প্রাচীন সৌন্দর্যের স্থাপত্য নিদর্শন চিনি মসজিদ। যা অনেকের কাছে চীনা মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি ব্রিটিশ আমলের খৃষ্টীয় কবরস্থান। নীলফামারী সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে গোলা হাট বাজারে অবস্থিত। ১৮৬৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামের দুজন ধর্মপ্রাণ সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথমে নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় তা টিনের ঘরে রূপান্তরিত হয়। পরে এলাকার লোকেরা মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে ফান্ড গঠনে উদ্যোগী হয়। এরপর শুরু হয় নির্মাণকাজ। মসজিদটি তৈরিতে প্রচুর মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। ২৭টি মিনার রয়েছে ও ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর আছে। রয়েছে ছোট ছোট ৩২টি মিনারসহ তিনটি বড় গম্বুজ। একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। দেশ-বিদেশের প্রচুর পর্যটক আসেন এই মসজিদের সৌন্দর্য উপভোগে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত