পাবনার ঈশ্বরদীতে কলা গাছে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পানামা রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে কয়েকশ’ হেক্টর জমির কলা গাছ। ফলে চোখের সামনেই মরছে হাজার হাজার গাছ। চাষিরা যে স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে কলার আবাদ করেছিলেন এখন রোগের কারনে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাঁদছেন তারা। স্থানীয় কলা চাষিরা জানান, একটি অজ্ঞাত ভাইরাস কলা গাছে আক্রমণ করেছে। এ ভাইরাস প্রথমে কলাগাছের পুরাতন পাতাতে আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে উপরের দিকে পৌঁছে কচি পাতাকেও আক্রমণ করে। এতে কলাপাতা বাদামী বর্ণ ও শুঙ্ক হয়ে যায়। কিছুদিন পর পাতা ঝরে পড়ে। কলাগাছের গোড়া বা কাণ্ড ভাইরাসের আক্রমণে হলদেটে থেকে লালচে আঁকাবাঁকা দাগ হয়। পরে গোড়ার নিচে ও ওপরের অংশ পচন ধরে গাছের মৃত্যু হয়। অনেক সময় কলা গাছ ফেটে যায়। গাছ কাটার পর ভেতরের সাদা অংশ কালচে দেখা যায়। এ বছর হাজার হাজার কলা গাছ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এছাড়াও এ ভাইরাসে আক্রান্ত কলার ওপরের অংশে কালচে দাগ হয়। কলা অপুক্ত ও স্বাদহীন হয়। এরোগ থেকে কলা গাছকে রক্ষা করা না গেলে শত শত চাষি বাধ্য হয়ে লোকসান থেকে বাঁচতে কলা চাষ বন্ধ করে দিবে। ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পদ্মার চরজুড়ে ১৮৪০ হেক্টর জমিতে কলার চাষাবাদ হয়েছে। এরমধ্যে লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নেই ১৮০০ হেক্টর জমিতে কলা আবাদ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কলাচাষে লাভবান হওয়ায় ইউনিয়নের কামালপুর, দাদাপুর, লক্ষ্মীকুণ্ডা, কৈকুণ্ডা, চরকুড়ুলিয়া, শান্তিনগর, ডিগ্রীর চরজুড়ে কৃষকরা অন্য ফসল না করে এবার শুধু কলার আবাদ করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫-৬ বছর আগে উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলজুড়ে শুরু হয় কলা চাষ। প্রথম বছরেই চাষিরা ব্যাপক লাভবান হওয়ায় পর্যায়ক্রমে এ ইউনিয়নের ১৮০০ হেক্টর জমিতে কলা চাষবাদ করাহয়। এছাড়াও উপজেলার অন্যান্য এলাকায় আরো ৪০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়। চরাঞ্চলে কলাচাষাবাদ বদলে দিয়েছে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। চাষিরা সবাই আর্থিকভাবে সাবলম্বী হয়েছেন। প্রতি বিঘা জমিতে ৩৫০ থেকে ৪০০ কলার চারা রোপন করা হয়। জমির খাজনা, সার-বীজ ও চাষাবাদ খরচে প্রতিটি কলা গাছে খরচ হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এখানকার প্রতিটি কলার ছড়ি বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি বিঘায় কৃষকের কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ হয়। এখানে সবচেয়ে চাষ হয় সরবি কলা। এছাড়াও মেহেরসাগর, অমৃতসাগর ও মন্দিরা কলার চাষ হয়। এছাড়াও কলা গাছের মুচি ও কলার ভেতরের অংশ সবজি হিসেবে বাজারে বেচাকেনা হয়। স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, রোগাক্রান্ত কলা গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পানামা রোগ মুক্ত চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। দুই তিন বছর পর কলা চাষ বন্ধ রেখে ওই জমিতে অন্য ফসল ফলাতে হবে। এছাড়াও জমিতে চুন প্রয়োগ করে মাটির জৈবশক্তি বাড়ালে পানামা রোগ থেকে কলা গাছ মুক্ত রাখা যেতে পারে।
কৃষ্ণদিয়ার গ্রামের চাষি মোক্তার হোসেন জোয়াদ্দার বলেন, মাটি দূষণের কারণে কলা গাছে ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে বলে আমার মনে হয়। ভাইরাসের আক্রমণে আমার কলাবাগানের বেশির ভাগ কলাগাছ ফেটে গেছে। আমি বাধ্য হয়ে এসব গাছ কেটে দিয়েছি। আমরা ১৫০ বিঘা জমিতে কলার আবাদ করেছি। অন্যান্যবার লাভবান হলেও এবার ভাইরাসের কারণে কলাতে লোকসান গুণতে হবে। ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে না পারলে আগামীতে কলা চাষ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। চরকুড়ুলিয়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক ও কলা চাষি সেলিম রেজা বলেন, উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডার ডিগ্রীচর ও শান্তিনগর এলাকাজুড়ে শত শত হেক্টর জমিতে পাঁচ বছর ধরে কলার আবাদ হচ্ছে। ২০২৩ সাল থেকে কলা বাগানে ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়। এবার শতকরা ৭০ ভাগ কলা বাগানে ভাইরাস আক্রমণ করেছে। লক্ষীকুণ্ডা ইউনিয়নের কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তা শামীমা খাতুন বলেন, ভাইরাসের আক্রান্ত কলা গাছের পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলা ও ছত্রাক নাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছি।
স্থানীয় কৃষি অফিস কৃষকদের এ ভাইরাস সম্পর্কে কোনো পরামর্শ দেয়নি কৃষকদের এ অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি কলা চাষির দ্বারে দ্বারে গিয়ে পরামর্শ দেওয়া সম্ভব নয়। যারা পরামর্শ চেয়েছেন তাদের দেওয়া হয়েছে। পাবনা জেলা কৃষি উপ পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, পানামা রোগে আক্রান্ত কলা গাছ উপড়ে ফেলতে হবে। সবসময় চেষ্টা করতে হবে ভাইরাস মুক্ত কলা চারা লাগানো তাহলে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।