ঢাকা ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কুষ্টিয়ায় তীব্র দাবদাহ কল আছে, জল নেই

কুষ্টিয়ায় তীব্র দাবদাহ কল আছে, জল নেই

চলছে তীব্র তাপদাহ। স্রোত নেই পদ্মায়। প্রমত্তা গড়াই নদীও আজ মৃতপ্রায়। বসন্ত শেষ হতে না হতেই পানির খুব একটা অস্তিত্ব নেই গড়াই নদীতে। গড়াই এখন পরিণত হয়েছে ছোট খালে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চলতি মৌসুমে এক ফোঁটা পানিও গড়ায়নি জিকে খালে। নেই বৃষ্টিপাতও। নেমে গেছে পানির স্তর। শুকিয়ে গেছে খাল, বিল, পুকুরসহ জলাশয়। কল থাকলেও মিলছে না জলের দেখা। বোরিংয়েও উঠছে না পানি। ফেঁটে চৌচির কৃষিজমি। সেজন্য কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে চলছে পানির জন্য হাহাকার। পানির জন্য দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে লাখ লাখ মানুষ। ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। সেখানে মানুষের পাশা পাশি পশুপাখি, জীববৈচিত্র্যসহ সকল স্তরের প্রাণির স্বাভাবিক জীবনযাপন পড়েছে হুমকির মুখে। বাসিন্দারা দ্রুত পানির সংকট নিরসনের দাবি জানান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত্রতত্র সাব মার্সিবল পাম্প স্থাপন এবং তার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণেই পানির এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেজন্য ভবিষ্যতে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে এবং নদী-নালা, খাল-বিলের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। গতকাল সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, স্রোতহীন পদ্মার বুকচিরে ধূ ধূ বালুচর। প্রমত্তা গড়াই শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলীয় চাপড়া, যদুবয়রা, বাগুলাট, পান্টি ও চাঁদপুর ইউনিয়নবাসীর একমাত্র পানিপ্রবাহের মাধ্যম জিকে খালে নেই পানি। অধিকাংশ পুকুরেও নেই পানি। ফেঁটে চৌচির কৃষিজমি। অধিকাংশ টিউবওয়েল (কল) এবং বোরিংয়ে (সেচ প্যাম্প) উঠছে না পানি। এক বাড়ির সাব-মার্সিবলের পানি দিয়ে প্রয়োজন মেটাচ্ছেন প্রতিবেশীরা। পানির জন্য সকল প্রাণিকুলে চলছে হাহাকার। দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে মানুষ। এ সময় যদুবয়রা ইউনিয়নের নীলের মাঠ নামক স্থানের কৃষক মো. লায়েব শেখ জানান, এবার খালে-বিলে পানি নাই। বৃষ্টিও নাই। পানির লেয়ার পরে গেছে। বোরিংয়েও পানি উঠছে না। বোরো ধান, পাট, সবজিসহ সব ধরনের চাষ নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা। জোতমোড়া গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানান, কয়েকমাস আগেও এক মিনিটেই বালতি-কলস ভরে যেত। কিন্তু এবার ১০-১৫ মিনিট ধরে চাপাচাপি করেও কলে পানি উঠছে না। মানুষ পানির জন্য খুব কষ্টে আছে। বাগুলাট ইউনিয়নের বাঁশগ্রাম এলাকার গৃহিণী পাপিয়া খাতুন জানান, পুকুরে টিউবওয়েলে কোথাও পানি নেই। গোসল, খাওয়া, গোবাদিপশু পালনসহ সব কাজ ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. আল আমিন জানান, বৃষ্টিপাত নেই, নদীতে পানিও নেই এবং যত্রতত্র সাবমার্সিবল স্থাপন করায় পানির স্তর নেমে গেছে। সেজন্য অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস জানান, পাম্প নষ্ট, সেজন্য নিজস্ব পানি ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদের জন্য কৃষকদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। তবে বোরিংয়েও পানি না উঠায় চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।

কুমারখালী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগের কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ জানান, তীব্র তাপদাহ চলছে। নদী, খাল-বিলের পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আপাতত বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবণা নেই বলে তিনি জানান। জানা গেছে, দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের সবকটি পাম্প বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এই প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার কৃষকদের সেচের পানি দেওয়া হতো। সর্বশেষ কুষ্টিয়ার চারটি উপজেলায় একটি পাম্পের সাহায্যে পানি সরবরাহ চালু ছিল। তবে গত এক মাস ধরে সেটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বোরো ধানের চারা রোপণসহ সকল ধরনের চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কয়েক লাখ কৃষক। এছাড়া জিকে খালে পানি থাকার অসংখ্য অগভীর নলকূপ ও বোরিংয়ে পানি উঠছে না। এই পাম্প দেশীয় প্রকৌশলী দিয়ে মেরামত করা সম্ভব না জানিয়ে ভেড়ামারা পাম্প হাউসের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, পাম্পগুলো স্থাপন করেছিল জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু যন্ত্রগুলো পুরোনো হওয়ায় একটু জটিলতা দেখা দিয়েছে। সেচ প্রকল্পের উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন জানান, এই সময়ে পদ্মায় পানি কম থাকায় দুটি জেলায় মাত্র চারটি উপজেলায় পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কৃষকসহ নানান মানুষের সমস্যা হচ্ছে। কবে নাগাদ পাম্প চালু হব, তা বলা যাচ্ছে না।

পানি ও ভূগর্ভস্থ নিয়ে গবেষণা করছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজওয়ানুল ইসলাম। তিনি জানান, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। তবে শঙ্কার কথা সবাই সাব মার্সিবলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদী কিংবা খালের পানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের চরম বিপাকে পড়তে হবে। পানি সংকটে চরম জনদুর্ভোগের কথা স্বীকার করেছেন কুষ্টিয়া ৪ (কুমারখালি-খোকসা) আসনের সংসদ সদস্য ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ। তিনি জানান, বিকল্প ব্যবস্থায় পাম্প স্থাপন বা চালুর জন্য পাউবো কর্তৃপক্ষ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পিডিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ চলছে। তিনি প্রত্যাশা করছেন খুব দ্রুত সংকট কেটে যাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত