মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে পদ্মানদী থেকে উৎপত্তি হয়ে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করা ২০টি খাল দখল-দূষণে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। গত ৩০ বছরে অনেক খাল সড়ক, ড্রেন, রাস্তা ও ঘরবাড়িতে পরিণত করেছে স্থানীয় দখলদাররা। বর্তমানে টিকে থাকা খালগুলোও মৃতপ্রায়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দখল-দূষণে এরই মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া ২০টি খাল। এর মধ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়া বেশ কয়েকটি খালের প্রাণ ফেরাতে এবার উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এসব খাল দিয়ে লঞ্চ, স্টিমার যোগে ঢাকা থেকে মালামাল নিয়ে আঞ্চলিক বাজারগুলোতে ব্যবসায়ী বেচা বিক্রি করতেন এবং খালগুলো ব্যবহার করে নৌকা যোগে এই অঞ্চলের কৃষকরা আড়িয়াল বিলসহ আশপাশের কৃষিজমির পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতেন। জেলেরা এই খালগুলোতে পদ্মা নদী থেকে আসা বড় বড় বাইল্যা, টেংড়া, মলা, ঢেলা, পুটি, রিঠা, চিংড়ি, বাইম ও গুতুম মাছসহ বিভিন্ন জাতের মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
উপজেলার বাঘড়া ইউনিয়নের স্থানীয় জেলে হরিপদ রাজবংশী দুঃখ করে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগেও এইসব খাল থেকে নানান জাতের মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করেছি। এখন এসব স্বপ্নের মতো মনে হয়। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার পশ্চিম বাঘড়া দোহার-শ্রীনগর উপজেলার সীমানা বিভাজন করা খালটি প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বাড়ি সংলগ্ন পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে দোহারের বেথুয়া, শাইনপুকুর গ্রাম ও শ্রীনগর উপজেলার বাঘড়া মুসল্লিকান্দা গ্রাম ঘেঁষে বরিবরখোলা, খৈরখোলা, বালুরচর, চিনারখোলা, ছত্রভোগ গ্রাম হয়ে আড়িয়াল বিলের খালে সংযোগ হয়, পশ্চিম বাঘড়ার মোসলেম মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন পদ্মানদী থেকে আরেকটি খাল উৎপত্তি হয়ে ঋষিপাড়া, রিপন ভূইয়া ও সালাম মেম্বারে বাড়ির সামনে দিয়ে মুসল্লিকান্দা আমতলা দিয়ে সীমান্ত ঘেঁষা খালে মিলিত হয়। বাঘড়া বাজার ঘেঁষে পদ্মানদী থেকে খালটি উৎপত্তি হয়ে বাজারের পাশ দিয়ে জাহানাবাদ ও নলটেক গ্রামের ভেতর দিয়ে ছত্রভোগ গ্রাম হয়ে আড়িয়াল বিলে মিলিত হয়। এই খালের একটি শাখা বাঘড়া বাজার ব্রিজ থেকে বাজার হয়ে সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বাড়ি হয়ে বাঘড়া ইউনিয়ন পরিষদের পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে রুদ্রপাড়া গ্রামের ভেতর হয়ে আড়িয়াল বিলে মিশছে। বাঘড়া বাজার স-মিল সংলগ্ন পদ্মানদী থেকে অপর আরেকটি খাল উৎপত্তি হয়ে বাঘড়া হাইস্কুলের দক্ষিণ পাশ দিয়ে মধ্যবাঘড়ার ভেতর দিয়ে তালুকদার বাড়ি মোড় হয়ে বৈচারপাড় গ্রামের পাশ দিয়ে আড়িয়াল বিলের মিশছে। এর একটি শাখা গাছিবাড়ী হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে পুনরায় সৈয়দ আলী মোল্লার বাড়ির সামনে দিয়ে মুল খালে মিলিত হয়।
মধ্যবাঘড়া শিকদারবাড়ি মোড়ে পদ্মানদী থেকে শিকদারবাড়ি নামে খালটি উৎপত্তি হয়ে প্রয়াত সাহাবুদ্দিন মাস্টার ও তানজিল চেয়ারম্যানের বাড়ির উত্তর পাশ দিয়ে আলামিন বাজার হয়ে কাঠালবাড়ী খালে সংযোগ হয়। মাঘডাল পদ্মানদী থেকে আরেকটি খাল উৎপত্তি হয়ে সাহাবুদ্দিন মাস্টারের বাড়ীর সামনে এসে শিকদারবাড়ী খালে সংযোগ হয়। ভাগ্যকুল ইউনিয়নের কামারগাঁও নয়াবাড়ী পদ্মানদী থেকে খালটির উৎপত্তি হয়ে উত্তরকামাগাঁও জগনাথপট্টি গ্রামের ভেতর দিয়ে আড়িয়াল বিলে পতিত হয়। এর একটি শাখা কামারগাঁও ঋষিবাড়ির পাশ দিয়ে আলামিন বাজার হয়ে উত্তর কামাগাঁও, কাঠালবাড়ি গ্রাম হয়ে আড়িয়াল বিলের খালে সংযোগ হয়। কামারগাঁও সূর্যখার বাড়ি সংলগ্ন পদ্মানদী থেকে নাগরনন্দী খালটির উৎপত্তি হয়ে মধ্যকামারগাঁও, উত্তরবালাশুর নতুনবাজার গ্রাম হয়ে আড়িয়াল বিলের খালে সংযোগ হয়।
এর একটি শাখা খাল উত্তরবালাশুর থেকে উৎপত্তি হয়ে বানিয়াবাড়ী গ্রামের ভিতর দিয়ে উত্তর বালাশুর খালপাড়া হয়ে আড়িয়াল বিলের সংযোগ হয়। ভাগ্যকুল বাজার সংলগ্ন পদ্মানদী থেকে ভাগ্যকুল বড় খালটির উৎপত্তি হয়ে বউবাজার, বাঘাডাঙ্গা হয়ে আড়িয়াল বিলের অপর খালে মিলিত হয়। লৌহজংয়ের খড়িয়া সংলগ্ন পদ্মানদী থেকে শ্রীনগর বড় খালটির উৎপত্তি হয়ে গোয়ালীমান্দ্রা ও শ্রীনগর বাজারের পাশ দিয়ে আড়িয়াল বিলের ভেতর হয়ে ধলেশ্বরীতে নদীতে সংযোগ হয়। এর একটি শাখা শ্রীনগর বাজার থেকে উৎপত্তি হয়ে শ্রীনগর-মুন্সীগঞ্জ সড়কের সংলগ্ন পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে সিরাজদিখান উপজেলার ডহুরিখালে সংযোগ হয়। অপর একটি শাখা দেউলভোগ শাহ বকশি (রঃ)-এর মাজারের পাশ থেকে উৎপত্তি হয়ে মাজারের পাশ দিয়ে হরপাড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে ষোলঘরখালে সংযোগ হয়। সিরাজদিখানের শুলপুর থেকে কেসিরোড সংলগ্ন পাশ দিয়ে বয়ে খালটি হাসাড়া, সাতগাঁও, তিনগাঁও ও তন্তর গ্রামের ভেতর দিয়ে অপর একটি খালে সংযোগ হয়।
এই খালগুলোর মধ্যে পশ্চিম বাঘড়া মোসলে মোল্লার বাড়ির ঘাটার খাল, বাঘড়া বাজার ব্রিজ শাখা খাল, গাছিবাড়ির শাখা খাল, শিকদারবাড়ি খাল, মাঘডাল খাল, নাগরনন্দীখাল, উত্তরবালাশুরে শাখা খাল, দেউলভোগ মাজার ও উপজেলার পাশের খাল ভরাটের ফলে অস্তিত্ব বিলিন হয়ে গেছে। এছাড়া অন্যান্য সব খাল দখল-দূষণে অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। উপজেলাবাসীর দাবি দ্রুত এসব খাল সংস্কার ও দখলমুক্ত করে এদের প্রাণ ফিরে আসলেও দেশের প্রকৃত ফিরে আসবে। তাই আমরা দ্রুত এই খালগুলো উদ্ধার ও সংস্কার চাই। স্থানীয় ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান মাদবর বলেন, দখল ও মৃত খাল উদ্ধারের চেয়ে আমরা আগে জীবিত খালগুলো রক্ষা করে সংস্কারের ব্যবস্থা করছি। বাঘড়া বাজার খাল সংস্কারের অনুমোদন হইছে অল্প কিছুদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে।
পানি উন্নয়ন মুন্সীগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী মো: তাওহিদুল ইসলাম বলেন, সারাদেশে যত খাল আছে সেগুলো আমরা শনাক্তের প্রক্রিয়া চলছে এবং ২য় ধাপে প্রতিটি খাল নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ধার করা হবে। শ্রীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: মোশারেফ হোসাইন বলেন, সব সময় আমরা দখলের সংবাদ পেলে আমরা দখল উচ্ছেদ করে থাকি এটা আমাদের চলমান কাজ এবং যেসব খাল ব্যাক্তিগত ভাবে রেকর্ড করে নিয়ে গেছে, সেগুলো আমরা উদ্ধারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছি।