চলমান তীব্র দাবদাহে উত্তরাঞ্চলের সমতলের চায়ের সবুজ বাগানগুলো এখন বিবর্ণ রং ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও গাছ মরে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবুজ চায়ের সমাহার নামে পরিচিত পঞ্চগড়ে তীব্র দাবদাহ আর খরায় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে সমতলের চা-শিল্পে। অব্যাহত খরতাপের কারণে বাগানের গাছ ঝলসে গেছে। গাছে গাছে আক্রমণ শুরু হয়েছে লাল মাকড়ের। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানের কারণে বাগানে সেচ ও পরিচর্যা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক চাষি। কোনো কোনো চাষি বাগান টেকানোর জন্য সেচ দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আবার কেউ বাগান উপড়ে ফেলছেন। চায়ের মৌসুমে কাঁচা চা-পাতা না পাওয়ায় বন্ধ রাখা হয়েছে বেশির ভাগ চায়ের কারখানা। খরা অব্যাহত থাকলে এবার সমতলে চায়ের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বাগানগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। ১ মার্চ থেকে চা মৌসুমের শুরু হলেও এর ৫০ দিন পেরিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত চা উৎপাদন হচ্ছে না। চায়ের নরম কুঁড়ি ঝলসে ও কুঁকড়ে গেছে। লাল মাকড়ে ছেয়ে গেছে অনেকের পুরো বাগান। সবুজে ভরা বাগানগুলো এখন বিবর্ণ রং ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও গাছ মরে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু চাষিদের তাতে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। দু’একজনকে পরিচর্যা করতে দেখা গেলেও বেশির ভাগ বাগান মালিক লোকসানের ভয়ে বাগানের পরিচর্যা করা বাদ দিয়েছেন বলে জানান। তাদের যুক্তি, পরিচর্যায় যে খরচ হবে সেটিই প-শ্রম। কারণ কারখানায় চা-পাতার দাম নেই। কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটে কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনছেন বাগান মালিকরা। সেই ক্ষত না সারতেই আবার খরার আক্রমণে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তেঁতুলিয়া উপজেলার শালবাহান মাঝিপাড়া এলাকার চা চাষি আবদুল খালেক বলেন, কয়েক বছর ধরে চা-পাতার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না আমরা। প্রতি কেজি চা-পাতা ১৮ থেকে ২০ টাকায় উৎপাদন করে আমাদের বিক্রি করতে হয়েছে ৮ থেকে ১০ টাকায়। তাও ওজন থেকে বিভিন্ন অঙ্কে বাদ দিয়ে আমাদের দাম দিত। এবার চলমান খরার কারণে চায়ের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। যেখানে বাগান সবুজ থাকার কথা সেখানে ঝলসে গেছে। পুরো বাগানে লাল মাকড়ের আক্রমণ শুরু হয়েছে। লোকসানের ভয়ে অনেকেই পরিচর্যা করা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কেউ বাগানই তুলে ফেলছেন। গত বছর এই সময়ে আমার বাগান থেকে ৫০০ কেজি পাতা তুলেছি। এবার ১০০ কেজিও তুলতে পারিনি। চা চাষি নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, আমরা এমনিতেই লোকসানে নাজেহাল হয়ে পড়েছি। তার মধ্যে এই খরা আর তীব্র গরমের কারণে বাগানগুলো টেকানো যাচ্ছে না। জগদল এলাকার চা চাষি আব্দুল হামিদ বলেন, আমি এই মৌসুমে প্রায় ৪০ হাজার টাকা বাগানে খরচ করেছি। এখন পর্যন্ত এক টাকাও তুলতে পারিনি। গরমের কারণে বাগানে পোকাণ্ডমাকড়ের এত বেশি আক্রমণ শুরু হয়েছে যে আমরা ঠেকাতে পারছি না। তাই শেষমেশ পরিচর্যা বাদ দিয়েছি। তিন বিঘার কিছু অংশ উপড়ে ফেলেছি। পঞ্চগড় সাজেদা রফিক চা কারখানার মালিক আকতারুজ্জামান সুমন বলেন, খরার কারণে এই সময়ে যে পরিমাণ চা-পাতা উৎপাদন হওয়ার কথা সে পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে না। তাই অনেক কারখানাই বন্ধ রাখা হয়েছে। পঞ্চগড় চা বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, সারা দেশের মতো পঞ্চগড়েও দাবদাহ চলছে। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা চায়ের জন্য ক্ষতিকারক। এ ছাড়া খরার কারণে বাগানগুলোতে লাল মাকড়সহ পোকাণ্ডমাকড়ের আক্রমণ বেড়ে গেছে। চাষিরা লোকসানের কারণে ওষুধ ও সেচ পর্যন্ত দিচ্ছেন না। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে সর্বপ্রথম পঞ্চগড়ে চা চাষের পরিকল্পপনা হাতে নেওয়া হয় এবং ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ শুরু হয়। বিগত দুই দশকে এখানে প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। ছোট-বড় চা-বাগান গড়ে উঠেছে প্রায় আট হাজার। উত্তরাঞ্চলের জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায় প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে চায়ের আবাদ। বিগত বছরগুলোতে এ অঞ্চলে চা চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাপ্তকৃত গত ২০২৩ মৌসুমে ১২ হাজার ১৩২ দশমিক ১৮ একর সমতল জমির ৩০টি চা বাগান এবং ৮ হাজারেরও অধিক ক্ষুদ্রায়তনের বাগান থেকে চা উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ কেজি। যা বিগত বছরের তুলনায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ২২৬ কেজি বেশি। এই উৎপাদনে টানা তিনবারের মতো উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে এ অঞ্চল।