ঢাকা ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

তাঁতের বদলে মেশিনে তৈরি হচ্ছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি

তাঁতের বদলে মেশিনে তৈরি হচ্ছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি

দেশজুড়ে এক নামেই খ্যাতি রয়েছে কুমিল্লার খাদির। এক সময় বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে হাজারো তাঁতি খাদি কাপড়ের সরবরাহের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র কয়েকটি তাঁত। দক্ষ কারিগর, প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ ও যথাযথ বাজারজাতকরণের অভাবে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী পণ্য খাদির বাজার। তবে তাঁতের তৈরি খাদিতে এখন লেগেছে মেশিনের ছোঁয়া। হাতে বোনা তাঁতের আসল খাদি এখন বিলুপ্তির পথে। এক সময় কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার, চান্দিনা ও মুরাদনগর উপজেলা থেকে তাঁতে তৈরি খাদি কাপড় অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করে। বাংলাদেশের পোশাকের ব্র্যান্ড হিসেবে কুমিল্লার খাদির কদর এখনো কমেনি। তবে কালের বিবর্তনে কারিগরের হাতে তাঁতের তৈরি আসল খাদি এখন বিলুপ্তির পথে। কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বড়কামতা ইউনিয়নের বড়কামতা গ্রাম এবং একই ইউনিয়নের জাফরাবাদ গ্রাম। বংশপরম্পরায় আসল খাদির কারিগর দেবিদ্বার এই বড়কামতা গ্রামের চিন্তাহরন দেবনাথ ও রণজিৎ দেবনাথ। ৭০ এর দশক থেকেই খাদির সুতা ও কাপড় তৈরিতে জড়িত তারা। সত্তোরোর্ধ্ব এই দুজন সম্পর্কে ভাই। তাদের এই গোষ্ঠীর মাধ্যমেই কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় খাদির তাঁতের কারিগররা ছড়িয়ে পড়েন বলে জানান তারা। তাঁতি চিন্তাহরন দেবনাথ তার গবেষণা চিন্তাভাবনা থেকে বলেন, মেশিনে বানানো খাদি আর তাঁতের খাদি দেখতে একইরকম; কিন্তু মানের অনেক তফাৎ। যারা আসল খাদি চিনে তারা সেটি খুঁজেই কিনে পরেন। তাঁতের খাদি দিয়েই কুমিল্লার খাদি বিশ্বের সম্মান পায় আর এখন সেই তাঁতই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লাতে তিনটি দোকানে পাওয়া যায় আসল খাদি। তাও খুব কম পরিমাণে। এক সময়ে যে এলাকাগুলোতে প্রায় ঘরেই তাঁত ছিল; কিন্তু এখন সেই গ্রামগুলোতে খাদি বুনার এখন আর তাঁত নেই। চিন্তাহরন দেবনাথ আরো জানান, একসময় কুমিল্লার দেবিদ্বার, চান্দিনা ও মুরাদনগর এলাকায় হাজার হাজার তাঁতি ছিল। নারীরা চরকায় খাদির সুতা কেটে আয় করত। পরিবারের ভরণপোষণ চলত সচ্ছলভাবে। কুমিল্লা থেকে সারা দেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাদির পোশাক রপ্তানি হতো। আর এখন উপজেলায় তাঁত খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রণজিৎ দেবনাথের ৮টি তাঁতের একটি ছাড়া সবই বন্ধ। শখের বশে দুই-এক থান বুনেন তিনি। তাঁতে বসেই জানালেন, খাদির প্রজন্ম এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এদিকে, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কুমিল্লা খাদি কাপড়ে সরবরাহকারী চান্দিনা সজল খদ্দর বস্ত্র নিকেতনের স্বত্বাধিকারী শংকর দেবনাথ জানান, এক সময়ে তাদের এটা পেশা ছিল। বর্তমানে তার ৫-৬টি তাঁত রয়েছে, এগুলো দিয়ে খাদি কাপড় উৎপাদন হয়। অন্যদের দিয়ে তিনি কাজ করান। এছাড়া বর্তমানে চান্দিনাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতের বদলে মেশিনে একইভাবে কিছুটা কম শ্রমমূল্যে খাদি কাপড় উৎপাদন করা হয়। মেশিনগুলোর বাজারমূল্য ৪০-৫০ হাজার টাকা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি। শংকর দেবনাথ জানান, পুরুষ ও নারী তাঁতিদের নিজের সংগৃহীত মেশিনগুলোতে কাপড় বুনন করেন। সুতা সরবরাহ করে তাদের মুজুরি দিয়ে খাদি কাপড় এবং তৈরি পোশাক সংগ্রহ করে বাজারে সরবরাহ করেন। এ ব্যবসায় বেশ সফল ও লাভবান হয়েছেন তিনি। তাঁতি রণজিৎ দেবনাথের দাবি, খাদি শুধু কুমিল্লা অঞ্চলের কাপড়। আদিকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ কাপড় তৈরির যে পেশাদার সংস্কৃতি চালু করেছিল তারই একটি অংশ খাদি। মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের সময় তা প্রসার পায়। কুমিল্লার খাদি এবং ভারতীয় খাদির মধ্যে বুননে পার্থক্য আছে। কুমিল্লার খাদি শুধু কুমিল্লারই। কুমিল্লার বিশুদ্ধ খদ্দর ভান্ডার, খাদি ভবন, খাদি ভূষণসহ কয়েকটি দোকানে পাওয়ায় যায় হাতে তৈরি আসল খাদি। এসব খাদি কাপড় মানে যেমন অনন্য তেমনি দামেও বেশি। তারপরও তাঁতের আসল খাদির চাহিদা মেশিনের খাদির চেয়ে বেশি বলেই মনে করেন সৌখিন খাদি ক্রেতা ও দোকানিরা। তাঁতে বুনা আসল খাদি কাপড়ের চাহিদা সম্পর্কে জানতে খাদি কাপড়ের কুমিল্লার পুরাতন ব্যবসায়ী আজিমুল আলম আজম জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে কাস্টমারদের মধ্যে কুমিল্লার আসল খাদি কাপড়ের চাহিদা বেড়ে চলেছে। স্থানীয় কাস্টমারদের চেয়ে এ চাহিদা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অর্থাৎ কুমিল্লার বাহিরের কাস্টমারদের তুলনামূলক বেশি। চিকন সুতার তৈরি স্ল্যাব খদ্দর মোটা সুতার তৈরি খাদি কাপড়কে বলা হয় বাপ্তা খদ্দর। এর মধ্যে স্ল্যাব খদ্দর কাপড়ের তৈরি পোশাকের মূল্য ও বেশি, চাহিদাও বেশি। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতীয় উপমহাদেশের কুমিল্লার তাঁতের খাদি এই অঞ্চলের একটি মৌলিক পণ্য যা সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করে। ঐতিহ্য হিসেবে মসলিনের মতোই খাদিকে পুণরুদ্ধার করা প্রয়োজন। ‘খাদি শুধু কাপড় কিংবা পোশাক নয়, এটি দেশপ্রেমের অনবদ্য দলিলও। বহুকাল আগেও যে কুমিল্লা অঞ্চল একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল তার প্রমাণ। সরকার চাইলেই মসলিনের মতো প্রকল্পভিত্তিক উন্নয় কার্যক্রম হাতে নিয়ে খাদির উত্তরণ ঘটাতে পারে।’ বললেন, লেখক গবেষক আহসানুল কবির। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান জানান, কুমিল্লার আসল খাদি কাপড়কে পুনরুদ্ধারের বিষয়টি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বের সঙ্গে জানানো হবে। এ ছাড়া কুমিল্লার খাদির ভৌগলিক স্বত্ব জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন প্রক্রিয়াধীন। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনে বিলেতি পণ্য বর্জনের ডাকে খাদি কাপড় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তবে গবেষকদের দাবি, সপ্তাদশ শতাব্দী থেকেই তৎকালীন ত্রিপুরার অংশ বর্তমান কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ খাদি কাপড় তৈরি করে নিজেদের চাহিদা মেটাতেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত