হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নিপুণ কারিগর বাবুই পাখি
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
এক সময় গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিতে দেখা মিলত সারি সারি তালগাছ ও খেজুরগাছ। সেখানে সবার নজর কাড়ত নিষ্ঠাবান বুননশিল্পী পাখির বাসা। সেই চিরচেনা তালগাছ আর বাবুই পাখির বাসা দুটোই এখন হাড়াতে বসেছে। তেমনি হাড়াতে বসেছে প্রাকৃতিক শিল্পী বাবুই পাখির ভোরবেলার কিচিরমিচির মধুর সুরে ডাকাডাকি। ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে’। বাবুই পাখিকে নিয়ে কবি রজনীকান্ত সেনের লেখা একটি কবিতার এ শব্দ চয়নগুলো বাবুই পাখির জীবনযুদ্ধের জয়গানকেই নির্দেশ করে। গ্রামে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ গ্রামীণ প্রকৃতি ও চড়ুই পাখির ডাকাডাকিতে প্রশান্তি পায়। সহজে ভুলতে পারে না এমন দৃশ্য। গ্রাম ও গ্রামীণ জীবনে চিরচেনা রূপের মধ্যে বাবুই পাখির বাসাও অন্যতম। ছোটদের কবিতার বইয়ে স্থান পাওয়া ছোট্ট কবিতাটির প্রতিফলন যেন বাবুই পাখির বাসা। ছড়াটি প্রাথমিকের বইয়ের পাঠ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাঠ্যপুস্তকের কবিতা পড়েই শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখির নিপুণ কারুশিল্পের কথা জানতে পারত। নির্বিচারে গাছ উজার আর একশ্রেণির শিকারির কারণে বিলুপ্তির পথে প্রকৃতির এ বুনন শিল্পীরা। তবে বর্তমানে মেহেরপুরের কিছু এলাকায় বাবুই পাখির বাসা দেখা যায়। এক সময় গ্রামাঞ্চলে সারি সারি উঁচু তালগাছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেত। এখন তা আর সচরাচর চোখে পড়ে না। খড়, তালপাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে বাবুই পাখি বাসা বাঁধে। এ বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি মজবুত। গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, আগের মতো আর চোখেই পড়ে না বাবুই পাখি ও তার তৈরি দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট বাসা তৈরির নৈসর্গিক দৃশ্য। বাবুই পাখির নিখুঁত বুননে এ বাসা টেনে ছেঁড়াও কষ্টসাধ্য। প্রতি তালগাছে ১০০ থেকে ১১০টি বাসা তৈরি করতে সময় লাগে ৮-১০ দিন। খড়, কুটা, তালপাতা, খেজুর পাতা, ঝাউ ও লতাণ্ডপাতা দিয়ে বাবুই পাখি উঁচু তালগাছে তাদের বাসা বাঁধে। জানা গেছে, পুরুষ বাবুই পাখি এক মৌসুমে ৬টি বাসা তৈরি করতে পারে। আমন ধান পাকার সময় হলো বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। এ সময় সাধারণত তাল ও খেজুর গাছের ডালে বাসা তৈরি করতে ব্যস্ত থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পরপরই বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য স্ত্রী বাবুই খেত থেকে ধান সংগ্রহ করে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের আগ্রাসী কার্যকলাপের বিরূপ প্রভাবই আজ বাবুই পাখি ও তার বাসা হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে দেশের গ্রামগঞ্জের কিছু কিছু অঞ্চলের তাল ও খেজুর গাছে এখনও চোখে পড়ে বাবুই পাখির বাসা। তবে তালগাছেই তাদের একমাত্র নিরাপদ জায়গা। সেখানে তারা বাসা বাঁধতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এ বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় লাগে, ঠিক তেমনি অনেক মজবুত। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা ছিঁড়ে নিচে পড়ে না। পুরুষ বাবুই পাখি বাসা তৈরির কাজ শেষ হলে সঙ্গী খুঁজতে বের হয়। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সাথী বানানোর জন্য পুরুষ বাবুই নিজেকে আকর্ষণীয় করতে খাল, বিল ও ডোবার পানিতে গোসল করে গাছের ডালে ডালে নেচে বেড়ায়। বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করতে বাসার ভিতর এক চিমটি গোবর রেখে জোনাকি পোকা ধরে এনে তার ওপর বসিয়ে দেয় এবং সকাল হলে ছেড়ে দেয়। প্রজনন সময় ছাড়া বাবুই পাখির গায়ে ও পিঠে তামাটে কালো বর্ণের দাগ হয়। ঠোঁট পুরো মোসাকার ও লেজ চৌকা। তবে প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখির রং হয় গাঢ় বাদামি। অন্য সময় বাবুই পাখির পিঠের পালকের মতোই বাদামি হয়। মুজিবনগরের গৌরিনগর গ্রামের বাসিন্দা আলিমুদ্দিন বলেন, আমার বাড়ির পাশে একটি তালগাছ ছিল সেখানে শত শত বাবুই পাখি তাদের বাসা বাঁধত। দিনশেষে সন্ধ্যাবেলায় ঝাঁকে ঝাঁকে বাবুই পাখি তাদের নীড়ে ফিরত আর কিচিরমিচির ডাকে পুরো এলাকা মাতিয়ে তুলত। ভোরবেলাতেও তাদের কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙত। কিন্তু এখন তালগাছ ও খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় সবই বিলুপ্তির পথে। ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মহসিন আলি আঙুর বলেন, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাবুই পাখির বাসা চিনে কিনা কিংবা দেখলেও চিনবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বাবুই পাখিরা সাধারণত তালগাছ ও খেজুর গাছেই বাসা তৈরি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। চড়ুই পাখি মানুষের বাসাবাড়িতে থাকতে পছন্দ করে; কিন্তু বাবুই পাখি পরিশ্রমী হয় এবং নিজের তৈরি বাসাতে থাকে। এদের বাসাগুলোও দেখতে চমৎকার এবং মজবুত হয়। বাবুই পাখিই এরকম সুন্দরভাবে বাসা তৈরি করতে পারদর্শী। এজন্যই বাবুই পাখিকে প্রকৃতির নিপুণ কারিগর বলা হয়। তিনি বলেন, কিছু মানুষ বুঝে না বুঝে তাদের শিকার করছে। এ ছাড়া দিন দিন তালগাছ ও খেজুরগাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে কারণে বাবুই পাখি এখন বিলুপ্তির পথে। বৃক্ষ নিধন ও নির্বিচারে পাখি শিকারের কারণে বাবুই পাখির বাসা এখন খুব একটা দেখা যায় না। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে পাখি নিধন বন্ধ করার পাশাপাশি পাখিদের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করতে হবে।