চাঁদপুরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে বরফ কল
৩৩টির মধ্যে পাঁচটি চলছে
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শওকত আলী, চাঁদপুর
চাঁদপুরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বরফ কলগুলো। ৩৩টি বরফকলের মধ্যে এখন চলছে মাত্র পাঁচটি। পুঁজির অভাব, কাচাঁমালের মূল্য বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল এবং মাছের আমদানি কম থাকায় চাঁদপুরে একের পর একএককরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বরফ কলগুলো। একসময়ে এখানে চালু থাকা ৩৩টির মধ্যে এখন চলছে মার পাঁচটি বরফকল। পর্যাপ্ত বরফের অভাবে অনেক সময় ইলিশ মাছ, জিউল মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ সরবরাহে এবং সংরক্ষণে বিপাকে পড়েন এখাকার মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে বরফকলগুলো বন্ধ থাকায় বড় স্টেশন মাছঘাটে বরফ সংকট দেখা দিয়েছে। দেশীয় মাছ বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের পড়তে হচ্ছে, চরম বিপাকে। বরফ সংকটে কর্মহীন হয়ে পড়েন বহু শ্রমিক। এ সংকট নিরসনে বর্তমানে বন্ধ থাকা কয়েকটি বরফ কল চালুর জন্য জেলা প্রশাসক বরাবরেও বরফ কল মালিক সমিতি একটি আবেদন দিয়েছেন। বর্তমানে নতুন বাজারের ইলমা শাহরিনসহ তিনটি ও পুরান বাজারের বিসমিল্লাহ্ নামে দুটি বরফ কল চালু রয়েছে। বর্তমানে দেশীয় ও জিউল মাছ সংরক্ষণ এবং সরবরাহে যে পরিমাণ বরফ উৎপাদন হয়, তা অপ্রতুল। মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলেন, আরো কয়েকটি বরফ কল চালু করলে বরফ সংকট থাকবে না। তবে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি পেলে নতুন বাজারের বড় স্টেশনের জলি ও রিয়াদ বরফ কল, পুরান বাজারের পূবালী আইস বরফ কল ও যমুনা আইস ফ্যাক্টরি চালু করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে চালু থাকা বরফকলগুলো বন্ধ হওয়ায় এর সাথে জড়িত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিকরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। চাঁদপুরে উৎপাদিত বরফ জেলার আট উপজেলার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়। ইলিশের অভিযান চলাকালীন সময়ে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত বাজারগুলোতে দেশিয় মাছের জন্য বরফের চাহিদা থাকে ব্যাপক। তখন দুটি বরফ কলে উৎপাদিত বরফ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকে। এ সময় পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও বরফ এনে ব্যবসায়ীরা মাছ সংরক্ষণ ও সরবরাহ করে থাকেন বলে জানা যায়। কিছুদিন আগেও চাঁদপুরে সাতটি বরফ কল সচল ছিল, যা থেকে সাড়ে ৪ হাজার ক্যান বরফ উৎপাদন হতো। বর্তমানে মাত্র পাঁচটি বরফ কল বরফ উৎপাদন করছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
জানা যায়, সাতটি বরফ কল চালু থাকলে সাড়ে ৪ হাজার বরফ উৎপাদন হয়। প্রতি ক্যান বরফ পাইকারি বিক্রি করেন ১৬০ টাকা দরে। উৎপাদিত সাড়ে ৪ হাজার বরফ বিক্রি করা হয় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু বিদ্যুৎ বিলসহ সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ এর সমপর্যায়ে চলে আসলে কীভাবে বরফ কল মালিকরা এ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকবেন- এমনই প্রশ্ন এখন বরফ ব্যবসায়ীদের। বন্ধ থাকা বরফ কল চালু করা সম্ভব বলে বরফ ব্যবসায়ীরা জানান। তারা জানান, সরকার যদি এ খাতে সুদমুক্ত লোনের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিল হ্রাসসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেন তাহলে পূর্বের ব্যবসায়ীরা আবার এ শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পাবে।
তবে পাইকার ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, প্রতি বছর ইলিশের ভরা মৌসুমের সময় সিন্ডিকেট করে বরফ কল মালিকরা সংকট তৈরি করেন। অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, অনেক সময় চাহিদা দেখে ১৬০ টাকা বরফ ক্যান ২০০ টাকা করে বিক্রি করছেন বরফ কলের মালিকরা। এছাড়া বরফ পাতলা করায় ওজনেও কম হচ্ছে। ফলে বরফ বিক্রি করতে গিয়ে লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের। শহরের নতুন বাজারের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ইলমা শাহরিন বরফ কলের মালিক মারনুস মাহমুদ তন্ময় জানান, পদ্মা মেঘনা নদীতে প্রচুর পরিমাণে বালু উত্তোলনের কারণে মাছের ডিম বিনষ্ট হওয়ায় এবং মাছের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় আগের মতো ইলিশ, জিওলসহ দেশীয় মাছ পাওয়া যায় না। তাই ভরা মৌসুমেও মাছের সংকট দেখা দেয়। এতে করেও বরফের চাহিদা কম থাকা, বিদ্্ুযৎ বিল বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বরফ কল। দীর্ঘ ৩০ বছর বরফ ব্যবসার সাথে জড়িত বরফ কলের ম্যানেজার সফিকুল ইসলাম জানান, প্রচুর পরিমাণ মাছ থাকলে সমস্যা নেই। মাছ কম থাকে তখন আমাদের লোকসান গুনতে হয়। তবে শীতকালে আমরা পুরো মৌসুম লোকসান দিয়ে থাকি। তখন বরফের চাহিদা কম থাকে দীর্ঘ পাঁচ মাস পর্যন্ত। এ পাঁচ মাসের পুরোটাই লোকসানে থাকতে হয়। বরফ কলগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় ধরনের কারণ। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ শবে বরাত বলেন, ইলিশ মাছ বিক্রি ও সংরক্ষণে ঘাটের কেউ যদি জড়িত থাকে কিন্তু জিওল মাছের বাজার ধরে রাখতে আরো কয়েকটি বরফ কল চালু করা প্রয়োজন। বরফ না থাকায় পাইকাররাও এখানে জিওল মাছ কিনতে আসছে না। যার কারণে এখানে বহু শ্রমিক অভাব-অনটনে অলস সময় কাটায়। তাই আরো কয়েকটি বরফ কল চালুর প্রয়োজনীয়তার উদ্যোগ নিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁদপুর বরফ কল মালিক সমিতির এক কর্মকর্তা জানান, এক সময়ে চাঁদপুরে জমজমাট ছিল বরফ ব্যবসা। তখন মাছের প্রচুর আমদানি হতো এবং বরফের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু একেক করে সব বন্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকটি বরফ কল চালু আছে। বাকিগুলো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে বন্ধের উপক্রম হয়ে পয়েছে। সরকার যদি এ বরফ শিল্পের প্রতি নজর দেয় বা সহযোগিতা করে তাহলে এ শিল্প আবার প্রাণ ফিরে পাবে আমি মনে করি।
উল্লখ্য, মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্তএই দুই মাস জাটকা সুরক্ষা দেয়া গেলে ইলিশের উৎপাদন ৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া ২০২৩ সালে চারটি নদী- পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া, ধনাগোদায় শুধুমাত্র ৩৪০৯২ মেট্রিক টন ইলিশ ও দেশীয় প্রজাতির ২৩৬৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয় বলে মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়।
এই বিশাল পরিমাণ মাছ সংরক্ষণ ও সরবরাহে বরফের ব্যাপক চাহিদা থাকে।