বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা আজ রোববার (২৬ মে) থেকে শুরু হচ্ছে। তিথি অনুযায়ী প্রতিবছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে উপজেলা সদরের অদূরে কেল্লাপোষী নামকস্থানে ৪৬৮ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এই মেলার আয়োজন করা হয়। স্থানীয়দের ভাষায়, যাকে ‘জামাইবরণ’ মেলাও বলা হয়ে থাকে।
মেলা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে বিগত ৪ বছর সেই ঐতিহ্যে ভাটা পড়ে। সেটির প্রভাব কেটে যাওয়ায় এই মেলাকে ঘিরে এবার গ্রামে গ্রামে চলছে রকমারি আয়োজন। আনন্দ-উল্লাস আর উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় লাখো মানুষ। তারা প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। মেলা উপলক্ষ্যে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে বাড়িতে দাওয়াত দিচ্ছেন। নিমন্ত্রণে নতুন-পুরোনো জামাই-বউ রয়েছেন তালিকার শীর্ষে। শ্বশুরালয়ে আসা জামাইরা থাকেন ভিন্ন মোজে। কারণ মেলা করতে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের সেলামী। সেই সেলামী আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাই বাবুরা মেলা থেকে খাঁসি কিনে শ্বশুর বাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্নসামগ্রী, সবচেয়ে বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কেনেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ঘুরে দেখেন। তাদের সার্কাস, নাগোরদেলা, হুন্ডা খেলা, জাদু খেলা, পতুল নাচ দেখিয়ে দিনব্যাপী আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরি খেলনাসামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। আর মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারা বছরের জন্য কিনে রাখেন গ্রামের সাধারণ মানুষ।
প্রতিটি মেলার পেছনেই কিছু না কিছু লোকগাঁথা কথা থাকে। কেল্লাপোষী মেলা সম্পর্কে তেমনি একটি লোক গাঁথার কথা জানা যায়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। এ সম্পর্কে জানা যায়, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরশজাত পুত্র এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরশজাত পুত্রের নাম গাজী মিয়া ও দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্যাসীর বেশ ধারন করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার কাছে যান। মুকুট রাজা ফকির বেশি যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন। এতে গাজী মিয়া দারুণ আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার কাছে থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোষী নামক স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর ওই দিনটি ছিল জ্যেষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রোববার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষ্যে কেল্লাপোষী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ-উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়েছে। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়। ওই দিনগুলোকে অম্লান করে রাখতে প্রতি বছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে তিন দিনব্যাপী মেলা বসে। আর এই মেলা উপলক্ষ্যে এলাকাবাসী নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেন। এছাড়া কাছে আত্মীয়-স্বজনের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা এলাকা। এদিকে মেলা শুরু প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা (লাঠি খেলা)। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে এবং সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাকঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা।
জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে তা শেষ করে। এবছর মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্নস্থানে মাদার খেলা চলছে। আর ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে সামনে রেখে এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে গেছে।