নীল রঙে মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি এবং দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর এ হাওর।
বর্ষা ও শুকনো মৌসুমে আলাদা রূপে সজ্জিত হয় হাওরটি। বর্ষা মৌসুম শেষে কখনো আকাশের মতো নীল, কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ থাকে পানি। এমন স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইট¤ু^র এ হাওর। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, অগণিত পাখির কলতান আর হিজল-করচ বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরেই।
শুকনো মৌসুমে- শতাধিক কান্দা ও বিলের পাড়ে সারি সারি হিজল-করচ, নলখাগড়া, ঝাউবনসহ নানা প্রজাতির গাছ ও বন সবুজরঙে অনন্য রূপধারণ করে। দিন দিন এ হাওরটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
শতাধিক কান্দা ও বিল নিয়ে বিস্তৃত হাওরটি ‘নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল’ নামে পরিচিত ও ‘রামসার সাইট হিসেবে ঘোষিত। এ হাওরে জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় পাখি ছাড়াও শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এ টাঙ্গুয়ার হাওর। গত ৬-৭ বছর আগেও টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে হাজার হাজার হিজল, করচ, নলখাগড়া, ঝাউবন, চাইল্যাবন, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসীসহ নানা প্রজাতির গাছ ও বন ছিল। হাওরের সুবিশাল জলরাশির বুক ও চারপাশজুড়ে ছিল ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ১৫০ প্রজাতির জলজ ও জলপদ্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এ ছাড়াও দুর্লভ প্রজাতির প্যালাসেস ফিশিং ইগল। বর্তমানে বদলে যাচ্ছে হাওরের এসব দৃশ্যপট।
তবে এ হাওরে ভ্রমণপিসুদের জন্য উপযুক্ত সময় হচ্ছে বর্ষা মৌসুম। এ মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্য ভ্রমণপিপাসু মানুষে জন্য রয়েছে নানা সুবিধা। সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি হাওরটিতে যাওয়ার ব্যবস্থা, প্রশস্ত নৌকায় থাকা এবং নৌকার মাঝেই স্বাস্থ্যসম্মত ও আধুনিক বাথরুমের ব্যবস্থা। সব মিলিয়েই বর্ষা মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যথেষ্ট আরামদায়ক।
কয়েক বছর আগেও সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর আসার পথের ভাঙা রাস্তা, সংকীর্ণ নৌকায় হামাগুঁড়ি দিয়ে চলাচল করার সমস্যা ছিল প্রকট। সব মিলিয়ে একসময় সবার পক্ষে হাওরে গিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব হয়ে উঠত না। এ হাওরে যাওয়া ও থাকা দুটিই যথেষ্ট দুঃসহ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য ও চাহিদার কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়া ও থাকা দুটিই হয়ে গেছে বেশ আরামদায়ক। টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম আকর্ষণ নৌকায় রাত্রিযাপন। এটি টাঙ্গুয়ার হাওরের ভ্রমণকে আলাদা করে অন্য সব ভ্রমণ থেকে। বছর কয়েক আগেও এ হাউজবোটের ব্যবস্থা ছিল না। তবে তিন বছরের ব্যবধানে টাঙ্গুয়ার হাওর আরো আরামদায়ক করতে দুই শতাধিক হাউজবোট তৈরি হয়েছে। এ হাউজবোটগুলোতে বিভিন্ন প্যাকেজে আরামদায়ক ভ্রমণের সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও স্বল্প বাজেটে হাওর ভ্রমণের জন্য রয়েছে ছোট-বড় কাঠ ও স্টিলের নৌকা। কেউ চাইলে পুরো একটি নৌকা ভাড়া করে নিতে পারবেন কিংবা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করেও ট্যুরে যেতে পারবেন। হাউজবোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আতাউর ইশতি বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য দুই শতাধিক আধুনিক ও আরামদায়ক হাউজবোট রয়েছে। এর মধ্যে হাউজবোট মালিক সমিতিতে প্রায় ১০০টি রেজিস্টার হাউজবোট রয়েছে। এ বছর আরও ৭০টির মতো হাউজবোট নতুন তৈরি করা হয়েছে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ রক্ষা করে পর্যটনকে আরো এগিয়ে নিতে হলে টাঙ্গুয়ার হাওরে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম চালু করতে হবে। প্লাস্টিক ফ্রি জোন ঘোষণা করে প্লাস্টিক নিয়ে হাওরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। হাওরের কোর এরিয়ায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা প্রবেশ করতে পারবে না। তিনি বলেন, সেখানে পর্যটকরা হাতেচালিত নৌকায় চলাচল করবেন। এতে পানি দূষণ কমবে এবং স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরে কোনো কংক্রিট স্ট্রাকচার নির্মাণ করা যাবে না। সড়কপথে যোগাযোগের উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য মানসম্মত আবাসিক হোটেল ও স্বাস্থ্যসম্মত রেস্তোরাঁ গড়ে তুললে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ তাহিরপুর উপজেলা হতে পারে দেশের অন্যতম সেরা পর্যটন। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা পারভিন বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ তাহিরপুরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে আগত পর্যটকদের সুবিধার্থে উপজেলা প্রশাসন সব সময় কাজ করে যাচ্ছে। পর্যটকদের যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হতে হয় সেদিকে আমরা সার্বক্ষণিক নজর রাখছি। এছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যটকদের নিরাপত্তায় হাওরে আনসার সদস্যরাও রয়েছে।