সরকারি রাস্তা ঘেরের বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহারসহ পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ করে যশোরের কেশবপুরে প্রভাবশালী মৎস্য ঘের ব্যবসায়ীরা সাড়ে ৪ হাজার মাছের ঘের গড়ে তুলেছেন। এতে একদিকে যেমন জলাবদ্ধতার কারণে বিলে কোনো ফসল আবাদ হচ্ছে না, অন্যদিকে শত শত হতদরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবার বিলে মাছ শিকার করতে ব্যর্থ হয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপণ করছেন। অপরিকল্পিতভাবে ঘেরের বেড়িবাঁধ করার কারণে হুমকিতে পড়েছে শতাধিক গ্রামীণ সড়ক। যুগ যুগ ধরে ঘের ব্যবসায়ীরা রাস্তাকে ঘেরের বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে চললেও প্রশাসন রয়েছে নীরব। কেশবপুর পৌরসভাসহ ১১টি ইউনিয়নে ৪ হাজার ৬৫৮টি মাছে ঘের রয়েছে। এর মধ্যে বলদালি, টেপুর বিল, বিল গরালিয়া, পদ্মবিল, ঘোচমারার বিল, কাদার বিল, হাজোয়ার বিল, বিল খুকশিয়া, বিষ্ণুপুর বিল, বাগমারার বিল, কালিচরণপুর বিল, নারায়নপুর, কাকবাঁধাল, ময়নাপুর বিল উল্লেখযোগ্য।
আশির দশকে এসব বিলে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত এলাকার হাজারও জেলে সম্প্রদায়। এছাড়া বিলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকায় ধান, পাট, কলাই, মশুড়ি, শাকসবজিসহ বিলে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ হতো। নব্বইয়ের দশকে এসব বিল, খাল, নদ-নদী অববাহিকার জমি দখল করে সমাজের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি মাছ চাষ শুরু করেন। ঘের ব্যবসায়ীরা গ্রামীণ প্রধান সড়কগুলো ঘেরের বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু করেন। ফলে বিলের ওপর নির্ভরশীল হাজারও জেলে সম্প্রদায় ও হতদরিদ্র মানুষ মাছ শিকার করতে ব্যর্থ হয়ে বাধ্য হয় অন্যপথ বেছে নিতে। ঘের মালিকরা সরকারি খালের পানি নিষ্কাশন পথে ব্যক্তিগতভাবে পাকা কালর্ভাট নির্মাণ করে পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ করার পাশাপাশি খালের মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড পোল্ডার নির্মাণ করায় উপজেলা ব্যাপী দেখা দেয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। বন্ধ হয়ে যায় বিলে কৃষকের স্বপ্নের ফসল আবাদ। জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পেতে ২০০০ সালের দিকে এসব বিলের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার কৃষক ঘের মালিকদের কাছ থেকে বিল উদ্ধারে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন। যা আজও অব্যাহত আছে।
কিন্তু ঘের মালিকরা ধনাঢ্য হওয়ায় প্রশাসন ও পুলিশকে ম্যানেজ করে কৃষকদের দাবিয়ে রাখা হয়। ঘের মালিকরা সরকারি খাল, পাকা সড়ক, গ্রামীণ শত শত পাকা ও ইটের সোলিং সড়ক ঘেরের বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করায় হুমকির মুখে পড়েছে এসব সড়ক। এরমধ্যে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, কেশবপুর-পাঁজিয়া সড়ক, কেশবপুর ভেরচি সড়ক, কেশবপুর ভান্ডারখোলা সড়ক, কলাগাছি-চুকনগর সড়ক, মঙ্গলকোট- হিজলডাঙ্গা সড়ক, ভান্ডারখোলা ভায়া আঠারো মাইল সড়ক, পরচক্রা সড়কসহ হাজারও গ্রামীণ ইটের সোলিং সড়ক ঘেরে ধসে বিলীন হয়ে গেছে। এসব সড়ক দিয়ে সাধারণ মানুষ, হাটুরেসহ ছোট-বড় যানবাহন চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া, ঘের মালিকরা সরকারি খালের পানি নিষ্কাশন পথে ব্যক্তিগতভাবে পাকা কালভার্ট দিয়ে পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ করায় উপজেলার বাগডাঙ্গা, মনোহরনগর, কালিচরণপুর গ্রামসহ ৮ থেকে ৯টি গ্রামের শত শত পরিবার বছরের অধিকাংশ সময় পানিবন্ধী জীবন যাপন করে থাকে।
সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার পরচক্রা বাজারের পাশে ঘের মালিক সুব্রত মন্ডল সড়কের পাশে গভীরভাবে ক্যানেল করে মাটি তুলে দিচ্ছে পিচের রাস্তার ওপর। বর্তমান পর্যাপ্ত বর্ষা না হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ঘের ভরাটের কাজ করছে। এতে রাস্তা ধসে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। উপজেলা প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ঘের মালিকরা সড়ক অবৈধভাবে বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে মাছ চাষ করার ফলে সড়কের পাশের ঢাল, সোল্ডারসহ পিচের রাস্তা ভেঙে গেছে। সরকারি বিধি অনুযায়ী সড়ক থেকে ৬ ফুট দূরত্বে পৃথক বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে মাছ চাষের বিধান রয়েছে। ঘের মালিকরা তা অমান্য করে সড়কের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। এসব সড়কের দু’পাশে ঢাল না থাকায় ঠিকাদারও কাজ করতে চায় না। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সজীব সাহা বলেন, এ উপজেলায় ৪ হাজার ৬৫৮টি মাছে ঘের রয়েছে। যার মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জলাকার রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫০০ ঘের ১২ মাসের রয়েছে। ঘের মালিকরা ২১টি সরকারি খাল দখল করে মাছ চাষ করছেন। অপরিকল্পিত ঘেরের জন্যে একদিকে যেমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি স্রোত সৃষ্টির অভাবে নদীগুলো মরে যাচ্ছে।