অবৈধ ক্লিনিক-ডয়াগনস্টিকে সয়লাব শ্যামনগর

প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলমগীর সিদ্দিকী, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা)

শ্যামনগরে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই নেই স্বাস্থ্য বিভাগের লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন হয় না। এতে একদিকে মানুষ হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিতও প্রতারিত, অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। বিভিন্ন তথ্যমতে, শ্যামনগরে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ২০টির মতো। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কয়েকজন নিজস্ব চিকিৎসক ও ডিপ্লমা নার্সসহ জনবল থাকার কথা, তা নেই কোনোটিতেই। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক চলছে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই। অধিকাংশ ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেই ডাক্তার, নার্স, প্যাথলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। এরপরও বছরের পর বছর চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। বিলিন্ন ক্লিনিকের সামনে রয়েছে নামিদামি ডাক্তারদের চটকদার সাইনবোর্ডে সোভা পাচ্ছে- ডাক্তার এমবিবিএস, বিসিএস, এফসিপিএস, ১ম পর্ব, ২য় পর্ব ইত্যাদি।

অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কমিশন পাচ্ছে দালাল চক্র। প্রতিটি ক্লিনিকের রয়েছে গ্রামে গ্রামে দালাল। সেসব দালালরা গ্রামে কারও কোনো রোগ হলে বিভিন্নভাবে কৌশলে ম্যানেজ করে ক্লিনিকে নিয়ে আসছে, সেখানে ডাক্তারকে দেখানোর পর প্রথমে একগাদা পরীক্ষা দিয়ে ৪-৫ হাজার টাকা বিল করছে। তার পর কিছু কঠিন রোগের কথা বলে আতঙ্কগ্রস্ত করে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে দ্রুত অপারেশন না করলে রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রোগীর অভিভাবকরা ভয় পেয়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বিক্রি করে ক্লিনিক মালিকের হাতে তুলে দিচ্ছে। এছাড়া সিজারের জন্য আসলে প্রথমে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে এবং প্যাথলজিতে বলে দেওয়া হচ্ছে- বাচ্চার ওজন যাই থাকুক না কেন, ২৫০০ গ্রাম করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। ক্লিনিকের কথা মতো ২৫০০ গ্রাম করে রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছে এবং ক্লিনিকে নিয়ে অপারেশন করে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। সিজারের পর অপরিপক্ব বাচ্চা হলে মা ও শিশুর বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে, অনেক সময় মৃত্যু হতেও দেখা যাচ্ছে। অবস্থা খারাপ দেখে জেলা বা বিভাগের হাসপাতালে প্রেরণও করছে অনেক সময়, রাস্তায় যেতে যেতে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতেও দেখা যাচ্ছে। এভাবে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রতিনিয়ত অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। জয়েন্টে ব্যথার রোগী এলে ১০০ টাকা দিয়ে একটা ডিপোমেড্রল ইনজেকশান নিয়ে পুশ করে দিয়ে ৪-৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ও অভিযোগ রয়েছে। কি ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, তার কোনো প্রেসক্রিপশন দেওয়া হচ্ছে না বা ব্যবহৃত বোতলটা চাইলেও দেওয়া হচ্ছে না। এতে প্রতারিত হচ্ছে রোগীরা। অথচ ডাক্তাররা জানিয়েছেন, ডিপোমেড্রল ইনজেকশন কর্টিশন প্রিপারেশন যা একবার পুশ করলে কোনো রোগে অন্য কোন ওষুধে কাজ করে না।

শ্যামনগরের শহরে সুন্দরবন অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেবা নার্সিং, সাইন্সল্যাব, রিডা প্রাইভেট হাসপাতাল, আনিকা প্রাইভেট হাসপাতাল, সুন্দরবন নার্সিং হোম, নগর প্রাইভেট হাসপাতাল, শামিমা, নার্সিং হোমসহ ২০টির মত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ৫০টির মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে শ্যামনগর সদরসহ বিভিন্ন হাট-বাজার ও গ্রামে-গঞ্জে। তাদের নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র। তারপরও বীরদর্পে চলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শ্যামনগর হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ধরে এনে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে অপারেশন করা হচ্ছে ক্লিনিকগুলোতে। কাগজপত্র না থাকার কথা স্বীকার করে এক প্রতিষ্ঠান মালিক বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি।’ শুধু আবেদন করেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সিভিল সার্জনকে বলে আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’ এ প্রতিষ্ঠানের কিছুটা দূরেই নওয়াবেকী বাজারে কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রযুক্তি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এ প্রতিষ্ঠানেরও নেই স্বাস্থ্য বিভাগের লাইসেন্স কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। এ ছাড়াও যেসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স আছে, তারাও বছরের পর বছর লাইসেন্স নবায়ন না করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে। সাতক্ষীরা পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয়ের উপ-পরিচালাক শরিফুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরায় ১২০টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে যার বেশিরভাগেরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ছাড়পত্র না নিয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান চালানোর কোনো সুযোগ নেই। জনবল সংকটের কারণে আমরা প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে নজরদারি করতে পারছি না। তবে দ্রুতই অবৈধভাবে চলা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাতক্ষীরা জেলা সিভিল সার্জন আব্দুস সালাম জানান, ‘জেলার সব কটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। যাদের লাইসেন্স নবায়ন নেই বা লাইসেন্স নেই, তাদের যথা শিগগিরই লাইসেন্স নবায়ন ও লাইসেন্স করতে বলা হয়েছে। তারা নির্দেশনা না মানলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’