বগুড়াবাসীর প্রাণের দাবি
আকবরিয়া লাচ্ছা সেমাইয়ের জিআই পণ্য স্বীকৃতি
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আজাহার আলী, বগুড়া
শত বছর ধরে বগুড়া ও উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে লাচ্ছা সেমাই। সারা দেশেই রয়েছে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাইয়ের কদর। ব্যবসায়ীদের কল্যাণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও যাচ্ছে এই সেমাই। জানা গেছে, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে কলকাতা থেকেই বগুড়ায় এ সেমাইয়ের প্রচলন ঘটে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী আকবরিয়া হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী ব্রিটিশ আমলে বগুড়া শহরে প্রথম লাচ্ছা সেমাই তৈরি করেন। এরপর ধীরে ধীরে দেশের চাহিদাকে কেন্দ্র করে জেলায় গড়ে উঠে কারখানা। বিশেষ পদ্ধতিতে ময়দা প্রক্রিয়াজাত করে সয়াবিন, ডালডা ও ঘিয়ে ভাজা হয় সেমাই। এরপর প্যাকেট করে তা বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে যাচ্ছে সভ্যতার যুগ। পাল্টে যাচ্ছে জীবন ব্যবস্থা। মানুষ সামাজিক জীব, মানুষের কল্যাণেই সমাজ। দূর অতীতকে জীবন্ত করে বর্তমানকে ভুলিয়ে দিতে চায় স্মৃতি। মনের বিচিত্র রং দিয়ে গড়ে উঠেছে ছোটবেলার স্মৃতি ঈদ উৎসব। সন্ধ্যা মেঘের রক্তিমার মতো সব মুছে গেলেও ঈদের দিনে আদর, স্নেহ ও ভালোবাসার সাথে যুক্ত হতো নতুন নতুন জামা কাপড় ও আকবরিয়ার লাচ্ছা সেমাই। দাদা-দাদি, নানা-নানির আদর আত্মীয়-স্বজনের প্রতিটি ঘরে ঘরে ঈদ আনন্দ আরো মুখরিত করে তুলে থাকে আকবরিয়া লাচ্ছা সেমাই। আমাদের অধিকাংশের শৈশব কেটেছে গাঁয়ে। একটা সময় ছিল ঈদ উৎসবে হাতে তৈরি নানা ধরনের সেমাইয়ের প্রচলন ছিল। ঈদ উৎসব পালনে সেগুলো বিলুপ্তির পথে। হাতের স্পর্শ ব্যতীত প্রযুক্তিনির্ভর আকবরিয়ার লাচ্ছা সেমাই মানুষের ঈদ উৎসবকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে। বিশেষ করে শুধুমাত্র ঈদ উৎসব নয়, অতিথি আপ্যায়ন, সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে লাচ্ছা সেমাইয়ের কদর বেড়েছে বহুগুণ। সেমাই আদিকাল হতে গ্রাম্য কৃষ্টিকালচারের একটা অংশ। মিশে আছে গ্রামের সকল মানুষের শৈশব স্মৃতিতে। দাদা-দাদুর ঘরে ঘুমানোর সুযোগ নেই, তাদের আদরের বকুনি নেই, শান বাঁধানো পুকুর নেই, পুকুরে ঝাঁপ দেয়া নেই, সারা বাড়ি ফলফলাদি গাছে পরিপূর্ণ নেই, পাখির ডাক নেই আছে শুধু শহুরে জীবনে স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করা। সময় স্বল্পতার কারণে দ্রুত নাস্তা প্রস্তুত করতে হবে ভেবে সারা বছর ঘরে রাখা হয় লাচ্ছা সেমাই যা গ্রাম্য কৃষ্টিকালচারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি অতীতকে জীবন্ত করেছে এবং বর্তমানে শানিত করে তোলে এ প্রজন্মকে। ‘আমার আনন্দ সবার আনন্দ হউক, আমার শুভ সকলের শুভ হউক, আমি যাহা পাই তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করি এ কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশে নানা ধরনের উৎসবে বগুড়া আকবরিয়া লাচ্ছা সেমাই এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বেদনা বিধুর জীবন উৎসব এক নতুন প্রাণ ও নির্মল আনন্দ সঞ্চার করে। তাই উৎসবের শালীনতা ও পবিত্রতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমাদের সবারই সচেতন ও আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। দলমত ভুলে গিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উৎসবকে করে তুলতে হবে ঐক্য ও প্রাণের মিলনের প্রতীক। সব উৎসব আমাদের কাছে নির্মল আনন্দের উৎস্য এবং কল্যাণের দৃষ্টি হতে পারে। বগুড়ার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের আনন্দের সঙ্গে এখন মিশে গেছে লাচ্ছা সেমাই। বগুড়ার এই সেমাই ছাড়া যেন ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ হয় না। তাই অতিথি অ্যাপায়নসহ স্বজনদের বাড়িতে সেমাই উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। আকবরিয়া লিমিটেড এর চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল বলেন, উত্তর জনপদে আমার বাবা মরহুম আকবর আলী মিঞা প্রথম লাচ্ছা সেমাই তৈরি করেছেন, তাই গুণগতমানে ভোক্তার সন্তুষ্টি, ঐতিহ্য ও জনগণের ব্যাপক সাড়াতে বরাবরই প্রথম থাকতে চাই। ঈদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ আকবরিয়া লাচ্ছা সেমাই। রসনার ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের কথা চিন্তা করে ও ক্রয় ক্ষমতার সামর্থ্য অনুযায়ী কয়েক ধরনের লাচ্ছা সেমাই তৈরি করছি আমরা।
আকবরিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন আলী দুলাল বলেন, লাচ্ছা সেমাইয়ের গুনগতমান, স্বাদ ও তৃপ্তির কোনো কমতি হবে না। আকবরিয়া বিগত সময়ে ক্রেতার পাশে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। ক্রেতার যে কোনো প্রত্যাশা পূরণে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মাফুজুল ইসলাম রাজ জানান, বগুড়ার সেমাইয়ের সুখ্যাতি সারা দেশে, লাচ্ছা সেমাইকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই ব্যবসার প্রসার হয়, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সারাদেশের বিভিন্ন জেলার গুটি কয়েক পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে এরইমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে।