ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মোবাইল গেমে আসক্ত শিশু ও যুবকরা

মোবাইল গেমে আসক্ত শিশু ও যুবকরা

দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে শ্যামনগরের শিশু থেকে শুরু করে যুবকদেরও মোবাইল গেমে আসক্তি। একে অপরের সঙ্গে শিশুদের মেলামেশা ক্রমশ কমছে, সে ক্ষেত্রে কথা শিখতেও দেরি হচ্ছে। কম বয়সে হারাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। এমবির টাকা জোগাড় করতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও বেছে নিচ্ছে শিশু ও যুবকরা। শিশুদের ইউটিউবে ভিডিও, মোবাইল গেমসে আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। তবে কিশোরদের ক্ষেত্রে পাবজি, ফ্রি-ফায়ার, সিওসির মতো গেমসের আসক্তি দেখা যাচ্ছে বেশি। ফলে শিশুদের আচরণ তো বটেই পড়াশোনাতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখাযায় শিশুরা দল বেঁধে নির্জন রাস্তায় বসছে এবং প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে খেলায় মেতে উঠছে। সন্ধা হলে পথচারীদের গতিরোধ করে টাকা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিচ্ছে। জানা যায়, এমবির টাকা জোগাড় করতে তারা এসব অপরাপধমূলক কাজ বেছে নিয়েছে। বলতে গেলে তাদের শৈশব কেড়ে নিচ্ছে এই ডিজিটাল ডিভাইস। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে তাদের বুদ্ধির বিকাশ রুদ্ধ হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, ঘরে টেলিভিশন থাকার পরও শিশুরা এখন মোবাইল ফোনেই বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ছে। এতে করে শারীরিক ও মানসিক নানা ঝুঁকি রয়েছে বলেও মনে করছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অভিভাবক বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েরা তাদের শিশু সন্তনকে শান্ত রাখতে তার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব দিয়ে দিচ্ছেন। গান, কার্টুন বা মজার ভিডিও চালিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত রাখছেন। কখনো আবার স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে, অনলাইন ক্লাসের কারণে বাধ্য হয়েই অনেকে শিশুর হাতে তুলে দিতে হচ্ছে স্মার্টফোন। এ রকম করে দিনের অনেকটা সময় শিশুদের হাতে স্মার্টফোন থাকায় তাদের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি জন্মাচ্ছে। যা থেকে শিশুদের বিরত রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। নষ্ট হচ্ছে শৈশবকাল ও তার মজার স্মৃতিগুলো। এখান থেকে ১০-১৫ বছর পরে এই সব শিশু ও কিশোরদের শৈশবকাল মনে করতে গেলে শুধু ফোনের কথা মনে পড়বে। কিন্তু ২০০৫ সালের আগে যাদরে জন্ম তারাই শেষ উপভোগ করেছে প্রকৃত শৈশবকাল ও তার মজার সময়গুলো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ থেকে ৬ ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, সাধারণ শিশুদের চেয়ে তাদের বুদ্ধির বিকাশ কম হচ্ছে। এ বিষয়ে শ্যামনগর মহসীন ডিগ্রি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, প্রতিনিয়ত ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে শিশু সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। এছাড়া শিশুরা রাস্তায় চলার সময় মোবাইলে আসক্ত হয়ে চলতে থাকে, অন্য কোনো দিকে মনোনিবেশ না থাকায়, দুর্ঘটনায় পড়ছে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী শিশু ও যুবকরা।

শ্যামনগর, মুন্সীগঞ্জ এলাকার শিশু সাহারার মা জানান, তার মেয়ে স্মার্ট টিভিতে সার্চ করে ও পাশাপাশি স্মার্ট মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ওয়েব সিরিজের কার্টুন দেখে থাকে। যেমন ফ্রি-ফায়ার গেমসহ অন্যান্য আরো অনেক কার্টুনের দেখে থাকে। সেই সব ওয়েব সিরিজের কার্টুনগুলোতে দেখা যায় নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলে। কিন্তু কার্টুন তো কার্টুনই। ছোট শিশু না বুঝে সেসব কার্টুন দেখে চুলার সামনে গিয়ে তার শরীরের সুতির জামার এক অংশ তার দুই হাত দিয়ে মুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে আবার নেভানোর চেষ্টা করে কিন্তু নেভাতে পারে না। দাউ দাউ করে শরীরে আগুন ধরে যায়। পরে বাসার লোকজন তাকে জাপটে ধরে আগুন নিভিয়ে ফেলে। ততক্ষণে তার শরীরের অনেক অংশ পুড়ে যায়। এদিকে, চক্ষু ও মানসিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিতে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে প্রায় ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশুদের দৃষ্টি ও মানসিক সমস্যা নিয়ে ব্যাপকভাবে চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে।

শিশু বিশেষজ্ঞ অজয় সরকার বলেন, মোবাইলের প্রতি আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করেছে, যার জন্য শিশুদের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। টিভি, মোবাইল গেম বা যেকোনো ধরনের ভার্চুয়াল এন্টারটেইনমেন্ট দেখার সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ হয়। এ ডোপামিন আমাদের মনে এক ভালো লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। ফলে অতি সহজেই শিশুরা এ ধরনের এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়ামগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই শিশুর স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের চোখের বিশ্রামের জন্য স্ক্রিন থেকে পর্যাপ্ত সময় বিরতি নিতে উপদেশ দিতে হবে। তাদের অবশ্যই সময় দিতে হবে। তিনি বলেন, শিশু-কিশোরেরা ইউটিউব, টিকটক, ফেসবুক, গেমে আসক্ত হয়ে পড়াশোনা বিমুখ হচ্ছে। একইসঙ্গে তাদের পরিপূর্ণ মানুষিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব ডিভাইস। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতাও। যার বড় প্রমাণ হচ্ছে কিশোর গ্যাং। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে চোখের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। শিশুদের পারিবারিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। তাই অভিভাবকরা শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক না থাকে তাহলে আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ না হয়ে আগামী দিনের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য শিশুদের মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। কোনো ভাবেই শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্ত হতে দেয়া যাবে না। তাদের নিকট মোবাইল ফোন ব্যবহার সীমিত করতে হবে। ােকৃতিক পরিবেশে তাদের পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুদের মোবাইল আসক্তি কাটাতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গাছ লাগানো, কাগজ কেটে হাতের কাজ করা, রং তুলি দিয়ে ছবি আঁকার অভ্যাস করালে শিশুর মোবাইলের িেত আগ্রহ কমবে। মোবাইল না দিয়ে শিশুকে গল্প শোনাতে শোনাতে খাওয়াতে পারেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানো আপনার অজান্তেই হতে পারে মানসিক চাপ। এ কারণে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সময় নির্দিষ্ট রাখুন। এতে আপনি ও শিশু দু’জনই ভালো থাকবেন। জানতে চাইলে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মিজানুর রহমান বলেন, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ক্রমশ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আসক্তি বাড়ছে। শহরের সাথে পাল্লা দিয়ে এখন গ্রামাঞ্চলেও র্স্মাট মোবাইল ফোনে শিশুদের আসক্তির হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে শিশুদের আচরণেও দেখা দিচ্ছে নানা নেতিবাচক পরিবর্তন। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিকভাবেও হয়ে পড়ছে অসুস্থ। তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাসের কারণে বাধ্য হয়েই শিশুর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল স্মার্ট মোবাইল ফোন। তখন নানা কারণে দিনের অনেকটা সময় হাতে থাকায় এটি এখন এক ধরনের আসক্তিতে রূপ নিয়েছে। তাছাড়া কিছুটা দায় অভিভাবকদেরও আছে। যেমন অনেক মায়েরাই শিশুদের ঘরে রাখতে গেমস ও কার্টুন দেখে সময় কাটানোর জন্য স্মার্ট মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি মোবাইল ফোন ব্যবহারে ক্ষতির দিক জেনেও সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য মোবাইল ফোনই একমাত্র মাধ্যম বলে বেছে নিয়েছেন অনেক অভিভাবকরা। এর ফলে শিশু মেধা শূণ্য হয়ে পড়ছে। তাই অভিভাবক সচেতন হলেই এর হার কমে আসবে বলে মনে করছেন তিনি। শ্যামনগরের বিভিন্ন বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবক জানান, স্কুল ফাঁকি দিয়ে ফোন নিয়ে পড়ে থাকে তাদের সন্তান। আবার ফোন কিনে না দিলেও স্কুল যাওয়া বা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। এমনকি আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে আদায় করছে ফোন। অনেকটা নিরুপায় হয়ে ফোন কিনে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা (অভিভাবক)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরে খেলার মাঠের অভাব এবং ঘরের বাইরে নিরাপত্তা কম থাকার কারণে শিশুরা বাইরে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে খেলতে পারছে না। যদিও ডিজিটাল ডিভাইস দুনিয়াকে পালটে দিয়েছে। তারপরও মোবাইল আসক্তি শিশুদের যে ক্ষতি করেছে তা অপূরণীয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত