জেলার অধিকাংশ এলাকাই নদীবেষ্টিত। সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা চাষ ও নৌকার হাট। আর এ মৌসুমভিত্তিক ফলের এই চাষাবাদকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর প্রচুর পর্যটকদের আগমন ঘটে পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার আটঘর সাপ্তাহিক নৌকার হাটে। শুধুমাত্র খাল নয়, কূলেও সাজানো রয়েছে দৃষ্টিনন্দন নৌকার সারি। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানে সৃষ্টি হবে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান। পর্যটনের এই ভরা মৌসুমে আসুন খালের মধ্যে সাজানো সারি সারি নৌকা, চারিদিকে পানি, ছোট ছোট খাল, মৃদু ঢেউ, ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে দুলছে সেগুলো, দুলে চলা নৌকা বা হাউজ বোট, দুই ধারে গ্রামীণ জীবন, নারিকেল-সুপারি আর কলাগাছের সারি, দিগন্ত বিস্তৃত হলুদণ্ডসবুজ ধানখেত, নদীর বাঁকে বাঁকে ডিঙি নিয়ে মাছের অপেক্ষা, ঘাটে ঘাটে নৌকায় করে বিকিকিনি, যত দূর চোখ যায় সাদা-গোলাপি শাপলা ফুলের মনোমুগ্ধকর রূপ, মাইলের পর মাইলজুড়ে সবুজ-সাদা-হলুদ পেয়ারার হাজারো গাছে ঝুলে থাকা, কচুরিপানার স্তূপে মাইলের পর মাইলজুড়ে ভাসমান সবজি আর আখের চাষ, আর সবচেয়ে জাদুকরি হলো সন্ধ্যা নদীর বড় বড় ডিমওয়ালা ইলিশ! যা একবার খেলে সারা জীবনে চাইলেও ভুলে থাকা সম্ভব হবে না। আর একদম ভরা নদীতে হেঁটে হেঁটে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবেন এই স্বরূপকাঠিতে! তবে আপনাকে যেতে হবে কোনো এক শুক্রবার, যেদিন সেখানে সাপ্তাহিক বড় হাট বসে। এই হলো পিরোজপুর আর তার মাঝখানে অবস্থিত স্বরূপে সেজে থাকা স্বরূপকাঠি এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে।
প্রবীণ ব্যবসায়ী সূত্রে জানায়, শত বছরের বেশি সময় ধরে আটঘর কুড়িয়ানায় চাষ হচ্ছে স্থানীয় জাতের পেয়ারা যা সারা দেশে বরিশালের পেয়ারা (বাংলার আপেলখ্যাত) নামে সুপরিচিত। জুন থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী ৫ মাস চলে বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ। এ মৌসুমে সহজে পথ চলাসহ ফসল ফলাদি বহনের প্রধান বাহক হিসেবে ব্যবহৃ হয় নৌকা। বাংলা বৈশাখ মাস থেকে শুরু হওয়া এ হাঁট চলে আশি^ন মাস পর্যন্ত। বছরের অন্য সময় নৌকার চাহিদা কম থাকলেও বর্ষা ও পানির মৌসুমকে কেন্দ্র করে জমে উঠছে। পারিবারিক পর্যায়ে বিলাঞ্চলের মানুষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয় এ নৌকার। বর্তমানে চলছে বাজার থেকে ছোট ছোট নৌকা ক্রয়ের মৌসুম। আর তাই ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই ভৌগোলিকভাবে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ও নাজিরপুর, পার্শ্ববর্তী ঝালকাঠির সদর এবং বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বেশ কিছু এলাকা বিলাঞ্চল। এসব এলাকায় শুকনো মৌসুমে সহজে লোকজন চলাচল করতে পারলেও, বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। বিলাঞ্চলে পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট না থাকায় এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত কিংবা গবাদিপশুর জন্য ঘাস সংগ্রহ, মাছ শিকার এবং বাগান থেকে পেয়ারা ও আমড়া সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হয় ছোট ছোট নৌকা, যার একটিতে দুইজন থেকে সর্বোচ্চ ৪-৫ জন যাতায়াত করতে পারে।
বিলাঞ্চল দিয়ে বেষ্টিত চার উপজেলার মানুষের নৌকা সংগ্রহের সবচেয়ে বড় উৎস নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর খালে অবস্থিত জেলার একমাত্র সাপ্তাহিক বড় নৌকার হাট। এ হাটে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা আসেন নৌকা ক্রয়ের জন্য। আর নৌকাগুলোর বেশিরভাগই তৈরি হয় নেছারাবাদ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। এ উপজেলায় কাঠের সহজলভ্যতার জন্যই অনেকে নৌকা তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মূলত মেহগনি, চাম্পল ও রেইনট্রি গাছ দিয়েই নৌকাগুলো তৈরি হয় যেগুলো কাঠের মান ভেদে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একটি নৌকা স্বাভাবিকভাবে ২-৩ বছর ব্যবহার করা যায়। নৌকার পাশাপাশি সাপ্তাহিক এ হাটে বৈঠাও বিক্রি হয়। আর প্রতি হাটে ২৫০-৩০০ নৌকা বিক্রি হয়। পর্যটকদের যতক্ষণ খুশি পেয়ারাবাগান উপভোগ করে ফিরে আসতে পারেন বা চাইলে থেকেও যেতে পারেন, কোনো এক জায়গায়। আর যদি যান ভাসমান ভেলায় ভেসে ভেসে, দুলে দুলে রাত কাটাতে চান তবে কয়েকজন মিলে ভাড়া করে নিতে পারেন কোনো এক বড়সড় ছুইওআলা নৌকা। যেখানে কাটাতে পারেন একটি দুর্লভ রাত, নদীর মাছ কিনে ভাজা করে খাবেন সেখানেই, রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবেন আর তারা গুনবেন রাতভর সন্ধ্যা নদীর ঢেউয়ে দুলে দুলে। এই হলো স্বরূপকাঠি, যার স্বরূপ বুঝতে একবার ঘুরে আসতেই হবে।