এইচএসসি পরীক্ষার মধ্যেও চলছে রমরমা প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য
অভিভাবক মহল উদ্বিগ্ন
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হুমায়ুন কবির, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি
সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠেছে প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টার। প্রাইভেট পড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, হাইস্কুল ও কলেজের শিক্ষকরা তাদের আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছেন এ কোচিং বাণিজ্যকে। তারা প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য করে বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকারিভাবে প্রাইভেট পড়ানো নিষিদ্ধ করা হলেও এ পর্যন্ত কালীগঞ্জ উপজেলা শহর ও গ্রাম এলাকায় তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। তাই অভিভাবক মহল তাদের সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। শিক্ষকরা শ্রমিককে সঠিকভাবে পারদ দান না করিয়ে বিশেষ করে শিশু শ্রেণি থেকে এসএসসি, এইচএসসি, ডিগ্রী, অনার্সসহ উচ্চতর শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ের নামে চলে রমরমা ব্যবসা। অনেক কোচিং সেন্টার ৮০% থেকে ১০০% নম্বর বা এ+ পাওয়ার গ্যারান্টি দিয়েও দেদারসে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। এছাড়া বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কক্ষ ব্যবহার করে প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। এমনকি ক্লাসের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় ফেল করার আশঙ্কা রয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরা বিষয় ভিত্তিক প্রতি মাসে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে কোচিংয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কালীগঞ্জ শহরের কাঠাল বাগান ও ১০ তলা ভবনের পাশে, ফয়লা
বোর্ড স্কুলের পাশে পৌরসভা ও ইউনিয়নের অলি-গলির মোড়ে মোড়ে গড়ে ওঠেছে শত শত কোচিং এবং প্রাইভেট সেন্টার। কোচিং বাণিজ্যের শিক্ষকরা বাসাবাড়ি, ফ্ল্যাট কিংবা রাস্তার পাশের একটি ছোট কক্ষ ভাড়া নিয়ে উপরে বড় বড় সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে চালু করেছে কোচিং সেন্টার। সেখানে ছোট কক্ষে কয়েকটি বেঞ্চ বসিয়ে ২৫-৩০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠদান করানো হয়। প্রাইভেট পড়া কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়তে হয়। কারণ স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ার ফলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। যারা স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ে না তারা এ বিশেষসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার চাপ কমিয়ে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী আনন্দের সঙ্গে শেখানোই নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম লক্ষ্য। আর এজন্য নতুন শিক্ষাক্রমে কমানো হয়েছে পরীক্ষা নির্ভরতা। বাড়ানো হয়েছে শিখনকালীন মূল্যায়ন। অর্থাৎ শিক্ষকরাই যার যার শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। স্বাভাবিক ভাবেই আশা করা হয়েছিল, এতে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিং কমবে। কিন্তু স্কুল-কলেজে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। নতুন শিক্ষাক্রমের পর ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে শিক্ষকদের প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য। নতুন শিক্ষাক্রমে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের হাতেই বেশির ভাগ নম্বর থাকায় শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে ৪/৫টি বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অনেক শিক্ষক আবার শ্রেণি কক্ষে চাপ প্রয়োগ করে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর নির্দেশনায় গত ২৯ জুন উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা উপলক্ষে দেশের সব কোচিং সেন্টার ৪৪ দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করলেও তা মানছেন না কালীগঞ্জের অধিকাংশ কোচিং সেন্টার গুলো। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ২৯ জুন থেকে আগামী ১১ আগস্ট পর্যন্ত (৪৪ দিন) বন্ধ থাকবে দেশের সব কোচিং সেন্টার। কিন্তু কালীগঞ্জের চিত্র সম্পূর্ণই ভিন্ন, কোচিং বন্ধের নির্দেশ থাকলেও বহাল তবিয়তে চলছে কোচিং সেন্টার গুলো। যা দেখার কেউ নেয়। দীর্ঘ ৪৪ দিন বন্ধ থাকলে কোচিং সেন্টার গুলো প্রায় ২ মাসের অর্থ থেকে বঞ্চিত হবে। গত ২৯ জুন প্রাইভেট কোচিং সেন্টার বন্ধের কথা থাকলেও তা বন্ধ করা হয়নি।
এইসব কোচিং সেন্টারগুলো মূলত শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়তা করা নয় বরং তাদের বাণিজ্য নিয়ে ব্যাতি ব্যস্ত রয়েছে। বিশেষ করে স্কুল কলেজে চাকরিরত শিক্ষক শিক্ষিকারা এই পেশায় জড়িয়ে পড়ে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার নীতিমালা বাস্তবায়নে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে শুরু করে ২০১২ সাল থেকে। উক্ত সালে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালাটি প্রণীত হলেও সেটা বিভিন্ন আইনি জটিলতায় বাস্তবায়ন করা হয় ২০১৯ সালে। এ কারণেই সরকার চেয়েছিল যে, এখানে একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে, সরকার কর্তৃক কোচিং সেন্টার গুলোর মনিটরিং ও নীতিমালা বাস্তবায়নে বিভাগীয় পর্যায়ে একটি, জেলা পর্যায়ে একটি ওউপজেলা পর্যায়ে একটি মোট তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল সে সময়। এছাড়াও কোচিং সেন্টারগুলোকে স্থানীয় সরকারের আওতায় নিবন্ধিত হতে হবে বলেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে সময়ের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছিলেন, একজন শিক্ষার্থী কেন কোচিং সেন্টারে যান, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষায় কোনো ঘাটতি আছে কিনা, পাঠ্যপুস্তকে সমস্যা আছে কিনা, কেন শিক্ষক সমিতির নেতারা অর্থ বাণিজ্য করতে নোট গাইড, সহায়ক বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করায় ইত্যাদি বিষয়গুলোও তারা তদারকি করবেন। শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে গত বছর ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ সালে নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। নীতিমালায় সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসার কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না বলা রয়েছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনো কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারবেন না। সরকারি বা এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম প্রযোজ্য হবে। সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য অবৈধ বলে গত ২০১৯ এর ৭ এ ফেব্রুয়ারি রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২ কে বৈধ বলে রায় কার্যকর করা হয়েছিল। এই নীতিমালার বাইরে গিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কেউ শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন না। বিশেষ করে উপজেলার ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে ৮ সদস্যের কমিটি গঠনের কথা নীতিমালায় বলা হয়েছে। বাস্তবে এসব কমিটির কার্যকারিতা দেখা যায় না। নীতিমালা অনুসারে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তার এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন ভাতা স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তি হতে পারে। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওহীন শিক্ষকের বেলাও একই শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
তবে এক যুগেও কালীগঞ্জ উপজেলায় একজন শিক্ষককেও কোচিং সেন্টার পরিচালনার দায়ে শাস্তির মুখে পড়তে দেখা যায়নি। কালীগঞ্জ শহরের ১০তলা ভবনের পিছনে বিভিন্ন বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে বড় বড় সাইন বোড ঝুলিয়ে বিশাল বিশাল বুলি লিখে কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্য চলছে দীর্ঘ বছর ধোরে। তন্মধ্যে রয়েছে কলেজ কোচিং সেন্টার, গোল্ডেন সান রেসিডেনিন্সয়াল স্কুল অ্যান্ড ক্যাডেট একাডেমি, জিনিয়াস কোচিং সেন্টার, কোচিং সেন্টার এনাড পারফেক্ট ইংলিশ হোম। আবার এ এলাকায় বিভিন্ন বাসা বাড়িতে শিক্ষকরা বাসা ভাড়া নিয়ে বছরের পর বছর প্রাইভেট পড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ভূষণ স্কুলের পুকুরপাড়, নিশ্চিন্তপুর শ্মশানের উপর, বনানী পাড়া, বলিদাপাড়া হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর সামনে, সুগার মিলের মাধ্যমিক বিদ্যালয়েসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকরা কোচিং প্রাইভেট পড়ালেও কর্তৃপক্ষ কখনোই তা নজরে আনেন না।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার মধ্যে প্রাইভেট পড়ানো হচ্ছে কিনা তা আমি জানি না। খোঁজখবর নিয়ে দেখব। ঝিনাইদহ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান (শিক্ষা ও আইসিটি) বলেন, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বিধি-নিষেধকে অমান্য করে যারা প্রাইভেট এবং কোচিং বাণিজ্য করছেন তাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। আমরা যাচাই করে ব্যবস্থা নেব।