ফেনীর উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরামে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নয়টি অংশে ভাঙনের দেখা দিয়েছে। এতে লোকালয়ে পানি ঢুকে অন্তত ২৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো মানুষ। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে উপজেলার পশ্চিম অলকার মাস্টারবাড়ি সংলগ্ন মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। রাত ১০টার দিকে মির্জানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ কাউতলি কাশিনগর ও চম্পকনগর এলাকায় বাঁধের দুইটি অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এর আগে এদিন বেলা ১১টার দিকে উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শালধর জহির চেয়ারম্যানের বাড়ি সংলগ্ন মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। পরে দক্ষিণ শালধর এলাকায় বাঁধের আরো একটি অংশে ভাঙনের দেখা দিয়েছে। এতে মালিপাথর, দক্ষিণ শালধর, নিলক্ষ্মী এবং পাগলিরকুল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত মাসেও বাঁধের একইস্থানে স্থানে ভাঙনের দেখা দিয়েছিল। দুপুরের দিকে বক্সমাহমুদ ইউনিয়নে কহুয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের টেটেশ্বর এলাকায় একটি ও সাতকুচিয়া এলাকায় দুইটি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে সাতকুচিয়া, বাঘমারা, টেটেশ্বর, চারিগ্রাম, অনন্তপুর, বাউরপাথর, বাউরখুমা, কোলাপাড়া, বেড়াবাড়িয়া, দুবলাচাদ ও উত্তর গুথুমা এলাকার শতশত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিকেলের দিকে উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পশ্চিম মির্জানগর এলাকার সিলোনিয়া নদীর বাঁধে ভাঙনের শুরু হয়। এতে কালীকৃষ্ণনগর, পশ্চিম মির্জানগর, গদানগর, উত্তর মনিপুর, দক্ষিণ মনিপুর, ছয়ঘরিয়া, দক্ষিণ কাউতলি, কাশিনগর, চম্পকনগর, দাশপাড়া ও সত্যনগর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মির্জানগর এলাকার বাসিন্দা মো. নোমান বলেন, এতো প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করতে এর আগে কখনো দেখিনি। বাড়িতে পানি ওঠে গেছে। খুব কষ্টে রাত পার করছি আমরা। ইব্রাহিম নামে আরেকজন বলেন, এই দিকের এলাকা উঁচু হওয়ায় সাধারণত বন্যার পানি প্রবেশ করে না। কিন্তু এবার ভারী বর্ষণে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি আরো বাড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে আমাদের। পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের সদস্য ফজলুল বারী মনছুর বলেন, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০১৮ সালের বন্যা নিজ চোখে দেখেছি। কখনো বাড়িতে পানি ওঠেনি। এবারই প্রথম আমার বাড়িতে পানি উঠল। পুরো এলাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। নদীর পানি না কমলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। চিথলিয়া ইউনিয়নের শালধর এলাকার কৃষক আবুল হাসেম বলেন, গতমাসে বন্যায় বোরো ধানের বীজতলা পানিতে তলিয়ে যায়। নতুন করে আবার বীজতলা তৈরি করে কয়েক দিন আগেই রোপণ করেছি। ফের নদীর বাঁধ ভেঙে এখন জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ক্ষতিতে আমরা না খেয়েই থাকতে হবে। ক্ষোভ প্রকাশ করে চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফেলতির কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বারবার লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে। একমাস আগে ভেঙে যাওয়া বাঁধ সংস্কারে গড়িমসি করার কারণে আবারো একই স্থানে ভাঙনের দেখা দিয়েছে। ভাঙন স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টু বলেন, পশ্চিম মির্জানগর এলাকায় সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে প্রায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ১০০ পরিবারের জন্য শুকনো খাবার দিয়েছেন। নদীর পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে ফুলগাজী বাজারও। এ ব্যাপারে ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম বলেন, ভারী বৃষ্টিপাতে মুহুরী নদীর পানি বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে ফুলগাজী পানি প্রবেশ করে মাছ, মাংস ও সবজির বাজারসহ আশপাশের সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (অ. দা.) মো. আবুল কাশেম বলেন, এর আগে কখনো এতো পানি দেখা যায়নি। গত দুইদিনের ভারি বর্ষণ ও উজানের পানিতে মুহুরী ও কহুয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ২৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙনের তথ্য পেয়েছি। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বাঁধের আরো কয়েকটি অংশে ভাঙনের শঙ্কা রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক সালেহ আহাম্মদ বলেন, টানা দুইদিন মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। গত শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা বিগত কয়েক বছরের হিসাবে সর্বোচ্চ। আগামী দশদিন জেলাজুড়ে বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে গত শুক্রবার বিকেলে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর বাঁধের ভাঙা অংশ পরিদর্শন করেছেন ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। এ সময় দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের কথা জানান তিনি। পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসকের নির্দেশ মোতাবেক সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বন্যাদুর্গতদের মাঝে ৫৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গতমাসেও ভারী বৃষ্টি ও উজানের পানিতে ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর মুহুরী নদীর বাঁধের একাধিক স্থানে ভেঙে অন্তত ৪৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল।