ফেনীর সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরাম ও ফুলগাজীতে দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় বন্যা হয়েছে। গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি ভাঙন অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজারো মানুষ। পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপজেলার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সড়কে বন্ধ হয়ে পড়েছে যান চলাচল। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২ আগস্ট মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে গত সোমবার দুপুর থেকে আবারও ভাঙন স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে পরশুরাম উপজেলার পশ্চিম অলকার মাস্টারবাড়ি সংলগ্ন মুহুরী নদীর বাঁধের ভাঙন অংশ, মির্জানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ কাউতলি কাশিনগর ও চম্পকনগর এলাকায় বাঁধের দুইটি অংশ, চিথলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শালধর জহির চেয়ারম্যানের বাড়ি সংলগ্ন, দক্ষিণ শালধর, কহুয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের টেটেশ্বর ও সাতকুচিয়া এলাকার ভাঙন অংশ এবং পশ্চিম মির্জানগর এলাকার সিলোনিয়া নদীর বাঁধের ভাঙন অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকালয়ে পানি ঢুকে দুই উপজেলার অন্তত ৭০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পরশুরামের কালীকৃষ্ণনগর এলাকার বাসিন্দা মো. শাহীন বলেন, অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ঘরবাড়ি তিনবার পানিতে তলিয়ে গেছে।
এভাবে টানা বৃষ্টি হলে আমাদের অবস্থা কি হবে আল্লাহ ভালো জানেন। প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করছে। খুব কষ্টে দিন পার করছি। বীরচন্দ্র নগর এলাকার বাসিন্দা বাহার উদ্দিন বলেন, এদিকের এলাকা উঁচু হওয়ায় সাধারণত বন্যার পানি প্রবেশ করে না। কিন্তু এবার ভারী বর্ষণে ঘর পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও আত্মগোপনে। কোনো ধরনের সহায়তা দূরের কথা, কেউ খোঁজখবরও নেননি আমাদের। ফুলগাজী উপজেলার নিলক্ষী এলাকার কৃষক আলী আজম বলেন, জুলাইয়ের বন্যায় ধানের বীজতলা পানিতে তলিয়ে যায়। নতুন করে বীজতলা তৈরি করে রোপণের কয়েকদিন পরে ২ আগস্ট আবারো পানিতে ডুবে যায়। গত দুইদিনের ভারী বৃষ্টিতে এখন নতুন করে সব জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। দেড় মাসের মধ্যে তিনবার বন্যায় হওয়া ক্ষতি কাটিয়ে উঠার সুযোগ নেই। আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফেলতির কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বারবার লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধ সংস্কারে গড়িমসি করার কারণে আবারো একই স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এখন ভাঙন স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (অ. দা.) মো. আবুল কাশেম বলেন, ২ আগস্ট মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭ অংশে ভাঙন সৃষ্টি হয়। সেগুলো মেরামত করার আগেই গত দুইদিনের ভারি বর্ষণ ও উজানের পানিতে ভাঙন অংশ দিয়ে আবারো লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা হাবিব শাপলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নদীর ১২টি ভাঙন অংশ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত ৯ হাজার ২০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ৫০ টন চাল মজুদ আছে। ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূঁইয়া বলেন, বন্যার পানিতে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ৪ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এখনো নদীর বাঁধ উপচে প্রবল স্রোতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। উপজেলায় ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১৮ মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে।
এদিকে গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও শহরের একাধিক সড়কেও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে যান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় চলাচলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষে। ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ফেনীতে টানা দুইদিন মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী কয়েকদিন জেলাজুড়ে বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা আছে।