ঝিনাইদহে মন্দিরের পুরোহিত আনন্দ গোপাল, সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস, খ্রিষ্টান হোমিও চিকিৎসক সমির উদ্দীন খাজা ও শিয়া সম্প্রদায়ের হোমিও চিকিৎসক আব্দুর রাজ্জাক খুনের পর ২০১৬ সালে ঝিনাইদহে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিভিষিকা নেমে আসে। ২০১৬ সাল জুড়েই গোটা ঝিনাইদহ জেলা যেন মৃত্যু উপত্যাকায় পরিণত হয়। যৌথ বাহিনী ও ডিবি পুলিশের অভিযানে একের পর এক ‘বন্দুক যুদ্ধের’ ঘটনা ঘটতে থাকে।
স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষক, কলেজ বা ভার্সিটির ছাত্র কেউ এই গুলির লড়াই থেকে বাদ পড়েনি। প্রথমে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর এখানে সেখানে গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকতো মানুষের। সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব হত্যার দায় স্বীকার করেনি। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালুহাটী গ্রামের খ্রিষ্টান হোমিও চিকিৎসক সমির উদ্দীন খাজা নিজ চেম্বারে খুন হন। ঘটনার দিন গান্না ইউনিয়নে গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা চলছিল। জনমানব শূন্য ছিল রাস্তাঘাট। সেই সুযোগে দু’জন বোরকা পরিহিত অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত বেলেখাল নামক বাজারে সমিরের চেম্বারে ঢুকে তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। ঘটনার এক দিন পর মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক উগ্র সংগঠন আইএস হত্যার কথিত দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। খবরটি দেশ বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। লুফে নেয় বিশ্ব মিডিয়া।
ঘটনা তদন্তে মাঠে নামে পুলিশ। এদিকে এ ঘটনার কিছুদিন পর ওই এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষক আবু হুরাইরা ও হাফেজ জসিম উদ্দীন নামে জামায়াত শিবিরের দুই নেতার লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ এই দুই হত্যাকান্ডের বিষয়ে কোন তথ্য দিতে না পারেনি। সমির হত্যার ৯ বছর পর তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন ও ছেলে মনিরুল ইসলাম দাবী করেন তার স্বামীর হত্যার সঙ্গে জড়িতে যাদের ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে তারা আসলে ভালো মানুষ ছিল। তাছাড়া হাফেজ জসিম তাদের পরিবারের সদস্য। একই বছরের ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় শিয়া মতবাদের হোমিও চিকিৎসক চাপালী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাককে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। কালীগঞ্জ শহরের নিমতলা এলাকায় তার লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনারও দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রচার করে আইএস।
হত্যার ৫ মাস পর রাজ্জাক হত্যার দায় প্রত্যাহার করে কথিত আইএস। রাজ্জাক হত্যার পর কালীগঞ্জের ইশ্বরবা গ্রামের মহসিন আলীর ছেলে কলেজ ছাত্র সোহান, চাপালী গ্রামের আবুজর গিফারী ও শামিমের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে সে সময় সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবী করা হয়। নিখোঁজের ১২ দিন পর চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার খাড়াগোদা গ্রামের পন্নাতলা মাঠে সোহানের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। অন্যদিকে আবুজর গিফারী ও শামিমের লাশ পাওয়া যায় যশোরের বিরামপুর এলাকায়। তাদের হত্যার বিষয়ে পুলিশের কাছে এখনো কোন তথ্য নেই। একই বছরের ৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার করোতিপাড়া গ্রামে গলাকেটে হত্যা করা হয় পুরোহিত আনন্দ গোপালকে। আনন্দ গোপাল হত্যার পর জেলাব্যাপী নতুন করে উদ্বেগ আর আতংক ছড়িয়ে পড়ে। জেলার পুলিশ সদস্যদের ঘুম খাওয়া হারাম হয়ে যায়। পুরোহিত হত্যার খবর দেশ বিদেশের মিডিয়ায় ঝড় তোলে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা, পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিরোধী দলের নেতারা আনন্দ গোপালের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে আসেন। করা হয় শান্তি সমাবেশ। পুরোহিত হত্যার ২৩ দিনের মাথায় হত্যা করা হয় শ্যামা নন্দ নামে এক সেবায়েতকে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাস্টসাগরা গ্রামে ভোর সকালে পুজোর জন্য ফুল তোলার সময় তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুরোহিত ও সেবায়েত হত্যার পর চরম বিভিষিকা ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে শহর বাজার ফাঁকা হয়ে যায়। দোকান পাটে বেচা কেনা দাঁড়ায় শূন্যের কোঠায়। পালাক্রমে পুলিশ আর গ্রামবাসি মন্দির ও গীর্জা পাহারা দিতে থাকেন। গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী সমাবেশ করা হয়। সে সময়ে জামায়াত শিবিরের উচ্চ পর্যায়ের বেশ কয়েক জন নেতা কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন।
পুলিশ জেলাব্যাপী এই বিভিষিকার জন্য সরাসরি জামায়াত শিবিরকে দায়ী করে জামায়াত শিবিরবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। এ সব অভিযানে প্রায় তিন হাজার নেতকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ অভিযানের সময় বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন অনেক জামায়াত শিবিরের নেতা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই সদর উপজেলার তেতুলবাড়িয়া গ্রামে শহিদ আল মাহমুদ ও আনিস বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। একদিন পর ২ জুলাই সদর উপজেলার আড়ুয়াকান্দি গ্রামে শিবির নেতা পারভেজ কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার কথা জানায় পুলিশ।
১৯ জুলাই একই স্থানে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন শিবির নেতা ও ইবির ছাত্র সাইফুল ইসলাম মামুন। ১২ আগষ্ট হরিণাকুন্ডুর জোড়াপুকুরিয়া গ্রামে নিখোঁজ মাদ্রাসা শিক্ষক পান্না হুজুরের লাশ পাওয়া যায়। ২৫ অক্টোবর ঝিনাইদহ শহরের বাইপাস সড়কে কথিত বন্দুক যুদ্ধে জামায়াত নেতা জহুরুল ইসলাম ও ডা: তারিক আল হাসান নিহত হন। পুলিশের পক্ষ থেকে সে সময় দাবী করা হয় বন্দুক যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিরা জেলায় নাশকতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার ছক আঁটছিলো।
এদের কেও কেও সেবায়েত ও পুরোহিত হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথাও সে সময় পুলিশ দাবী করে। তবে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের দাবী ছিল পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এদের লাশ পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালের বিচারবহির্ভূত এসব হত্যা নিয়ে বর্তমান ঝিনাইদহ পুলিশের কর্মকর্তারা মুখ খোলেননি। তাদের ভাষ্য ব্যক্তির দায় গোটা পুলিশ বাহিনী নিবে না। আগে যারা ঝিনাইদহে দায়িত্বে ছিলেন কেবল তারাই এসব নিয়ে বলতে পারবেন।