মহারাজা স্কুলে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য
সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের অঢেল সম্পদ
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নাটোর প্রতিনিধি
নাটোরে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মহারাজা জে.এন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ব্যাক ডেট এবং তথ্য জালিয়াতি করে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে অন্তত ২ কোটি টাকা কামিয়েছে সভাপতি জাহিদুর রহমান জাহিদ ও প্রধান শিক্ষক মো: আশরাফুল ইসলাম। সেই টাকায় শহরে বাড়ি, গাড়ি, গ্রামে বিঘা বিঘা জমি, গরুর ফার্ম ও পুকুরের ব্যবসাসহ কয়েক বছরে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালে কলেজ শাখার যাত্রা শুরু। পাঠদানের অনুমতি, একাডেমিক স্বীকৃতি পর এমপিওর জন্য আশায় ছিল শিক্ষক ও কর্মচারীরা। প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালে এমপিও ঘোষণার পর প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহিদুর রহমান জাহিদ এবং প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বিভিন্ন অজুহাতে ও কৌশলে এমপিও করানোর বাবদ ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে কোটি টাকার বাণিজ্য করে।
ব্যানবেইজের তথ্যমতে শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুজন প্রভাষক গণিতের মো: আব্দুল মান্নান এবং ইংরেজি প্রভাষক ওমর ফারুক কর্মরত থাকলেও কলেজ এমপিও ঘোষণার পর তাদের বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিয়ে কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। দুই প্রভাষকের পরিবর্তে অর্ধ কোটি টাকার বিনিময়ে গণিত প্রভাষক পদে মোঃ আশরাফুল ইসলাম কে ও ইংরেজি বিষয়ে প্রভাষক পদে সুনাম চন্দ্রকে পেছনের তারিখ দেখিয়ে (ব্যাকডেটে) ২০১৫ সালে নিয়োগ দেয়। পুনরায় আবার রেজুলেশন করে তৎকালীন ডিজি প্রতিনিধি ও এন এস সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দিলীপ কুমার ভদ্র মহোদয়ের কাছে স্বাক্ষর করাতে গেলে তিনি নিয়মের বাইরে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর রাজনীতি চাপ ও মোটা অংকের টাকা প্রস্তাব দিয়েও তিনি ফিরিয়ে দেন।
পরে নিয়োগকালীন ডিজি প্রতিনিধির স্বাক্ষর জাল করে নিজেরাই সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং এমপিওভূক্ত করান। এ বিষয়ে তৎকালীন ডিজি প্রতিনিধি ও এন এস সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দিলীপ কুমার ভদ্র বলেন, মহারাজার কলেজ শাখাটি এমপিওভুক্ত ঘোষণা হওয়ার পর বর্তমান প্রধান শিক্ষক আশরাফ সাহেব আমার বাসায় এসে তার নিজের মন মতো তৈরি করা রেজুলেশন, নিয়োগ ফলাফল সীটে স্বাক্ষর করতে বলেন। কিন্তু ২০১৫ সালের সঙ্গে মিল না থাকায় তাতে আমি স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানাই।
রাজননৈতিক নেতার ফোন এবং টাকার প্রস্তাব দিলেও এই অবৈধ কাজে সম্মতি না দিয়ে এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের পরামর্শ দেই। পরে শুনলাম আমার স্বাক্ষর জাল করে সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্মন্ন করেছে। ব্যানবেইস ছাড়াও ২০১৮ সালে সরকারিভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর অডিটেও পরে অবৈধ নিয়োগকৃত ২ জন প্রভাষক ছাড়া ওই শিক্ষকদের তথ্য প্রদান করা হয়েছে। নাম না প্রকাশে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, বিভিন্ন কৌশলে আমাদের সবার কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জোর করে আদায় করেছে। এমনকি প্রাপ্ত বকেয়া টাকা তুলতে জনপ্রতি লক্ষাধিক করেও টাকা নিয়েছে প্রধান শিক্ষক। সবশেষ ২০২১ সালের সর্বশেষ এমপিও নীতি মালা অনুসারে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদস) পর্যন্ত ৫ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ হওয়ার কথা কিন্তু নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে তথ্য জালিয়াতি করে ৯ জনকে নিয়োগ দিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়। ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী প্রাপ্ত ৩ জন পূরণ থাকা সত্ত্বেও আবারো মোটা অংকের টাকা দিয়ে এ মাসের ১ তারিখে ১ জনকে নিয়োগ দিয়েছে।
জাহিদ সভাপতি হওয়ার পর বৈধ অবৈধ মিলে অন্তত ১৫ জন ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির লোক বল নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ থেকে অন্তত প্রায় ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক। নিয়োগকৃত ব্যক্তিরা সবাই নিজের ভাগ্নে, ভাতিজা বউসহ নিকটাত্মীয়। নিয়োগকৃত এই পদগুলোতে একাধিক ব্যক্তির নিকট থেকে টাকা নেয়ার অকাট্য তথ্যভিত্তিক প্রমাণ রয়েছে। জাহিদ সভাপতি হওয়ার পর থেকে অবৈধ টাকা আয় করার আতুর ঘরে পরিণত করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি বিভিন্ন অনুদানের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে শত বছরের প্রায় ২০টি পুরাতন গাছ বিক্রি করে টাকা লুটপাট করার অভিযোগও রয়েছে এই সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। জালিয়াতি করে নিয়োগের টাকায় অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জাহিদুর রহমান জাহিদের মোবাইল ফোনে কল করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তিনি ছাত্রদের কোটা আন্দোলন থেকে পলাতক রয়েছে। তার নামে হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলাও রয়েছে। ২০১৫ সালে নিয়োগকালীন প্রধান শিক্ষক মো: আব্দুল মজিদ বলেন, সরকারি বিধি মোতাবেক আমি সেই সময় এন এস কলেজে গিয়ে ডিজি মহোদয় ও অন্যান্য সদস্যদের সাথে নিয়ে নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন করেছিলাম। পরে ব্যাক ডেটে কোনো নিয়োগের সাথে আমার সম্পৃততা নেই। আমি কোথায় কোনো স্বাক্ষর করিনি। স্বাক্ষর জালিয়াতি নিয়োগ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো: আশরাফুল ইসলাম স্বীকার করে বলেন, আমি সভাপতির চাপে এসব করেছি। বেতন করানোসহ আর্থিক বিষয়ে সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।