এমপির ছোঁয়ায় শত কোটি টাকার মালিক মুক্তা রানী!
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের মুক্তা রানী (৪৫)। বাবা পেঁচা সরকার চন্ডিপুর বাজারে এক সময় চায়ের দোকান করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ২০১০ সালে সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আয়া পদে চাকরি নেন মুক্তা। দেখতে মায়াবি এবং আবেদনময়ী ছিলেন তিনি। আর এই মায়ার জালে পড়েন ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। তার হাতের ছোঁয়ায় আয়া থেকে হয়ে যান ঠিকাদার। চার বছর আয়া পদে চাকরির পর ২০১৪ সালে চাকরি ছেড়ে দেন মুক্তা। এরপর এমপি রমেশ চন্দ্র সেনের ছোট স্ত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কেউ কেউ মজা করে ছোট কাকি বলেও ডাকতেন। মুক্তা রানী থেকে নাম পরিবর্তন করে হয়ে ওঠেন মুক্তা সেন। ধীরে ধীরে শুরু হয় মুক্তা সেনের কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার গল্প।
২০১৪ সালে আয়া পদে চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর ঠিকাদারি খাতায় নাম লিখান মুক্তা। শুরু হয় ঠিকাদারি ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে যার বর্তমান নাম ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। টেন্ডার ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে হাসপাতালের যাবতীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাবার সরবরাহ, স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান মুক্তা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তা রানীর ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, রেন্ট-এ কারের শো-রুম, ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ইসলামবাগ মহল্লায় দুই তলাবিশিষ্ট বিশাল বাড়ি, শান্তিনগরে প্লট আকারে ৫ শতক করে দুটি জমি, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলএসডি গোডাউনের পাশে ১০ শতক জমি, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে ৩চগ নামে একটি রেস্টুরেন্ট, সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাদুপাড়ায় বাড়ি-জমি ও সয়াবিন তেলের কারখানা, চন্ডিপুরে বাড়ি, মিল-চাতাল ও পুকুর ছাড়াও রয়েছে ১০ একর আবাদি জমি।
সদর উপজেলার গড়েয়া বাসস্ট্যান্ডে ৮ শতক জমির উপরে বাড়ি। এছাড়া তিনি নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখলসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি ও বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার রয়েছে। তিনি এতোই টাকার মালিক হয়েছেন যে, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নওগাঁর অটো রাইস মিল কয়েক কোটি টাকায় কিনে নেন এই মুক্তা। চলতি বছরে মুক্তার দুই ছেলে তূর্য ও মাধুর্য এন্টারপ্রাইজ নামে পূবালী ব্যাংক হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৩৮ লাখ ২০৯৯ টাকা। সাবেক মন্ত্রী ও এমপি রমেশ চন্দ্র সেন আটক হওয়ার পর দিন সব টাকা তুলে নেন তিনি। বর্তমানে তার ছেলে তূর্যের অ্যাকাউন্টে রয়েছে ৬ হাজার ৪১৭ টাকা। এছাড়াও জনতা, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে তাদের হিসাব নম্বরে গত দুই বছরে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বড় ভাই নারায়ন ঠাকুর ভারতে চলে যান। পরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার জলপাইগুড়ি সদর মহুকুমার অন্তগর্ত ময়নাগুড়ি পৌরশহরে জমি ক্রয় করে বাসাবাড়ি করেন। তিনি ভারতেরও একজন নাগরিক। পরে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং বোনের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে ঠিকাদারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নারায়ন ঠাকুর হত্যা মামলার পলাতক আসামি ছিলেন। পরে জামাই বাবু (মন্ত্রী)’র প্রভাব আর রাজনৈতিক দাপটে তারা হয়ে ওঠেন প্রতাপশালী। তার মাসিতো ভাই দুলালকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাসিতো বোনের ছেলে নিপুণকে হাসপাতালের ঠিকাদারি, বোনের মেয়ে মৌকে স্কুলের শিক্ষিকা, আরেক বোনের ছেলে জয়কে রাজস্ব ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি দিয়েছেন তার দুই শতাধিক আত্মীয়-স্বজনকে।
মুক্তা রানী রায়ের মাসিতো ভাই ফণি রায় বলেন, সবাই আমাকে বলে মন্ত্রী নাকি আমার ভগ্নিপতি। আমি বলি, বিয়ে তো খেলাম না। মুক্তার পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো। পরে নিজে বাড়ি কিনেছে। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি নিয়ে দিয়েছে। এলাকায় কিছু জমিও কিনেছে। আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সবাই তাকে এমপির ছোট বউ হিসেবে চিনতাম। এলাকায় জমি, তার ভাই ও বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। তাদের বংশের সবার চাকরি হয়েছে। চাকরির বিনিময়ে টাকা নিয়েছে আবার কারো কাছে জমিও নিয়েছে। পাশেই মিল-চাতাল পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা অগ্রীমও দিয়েছিল। এ বিষয়ে মুক্তা রানীর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ২০১০ সালে মুক্তা রানী আয়া পদে যোগদান করেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি সেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঠাকুরগাঁও সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তাহসীন মুনাবীল হক বলেন, আয় বহির্ভূত সম্পদ উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই। কেউ এসবে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।