কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩৮ কোটি টাকার অডিট আপত্তি
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচএম আরিফ, কুষ্টিয়া
দড়-দুই বছর আগে হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কুষ্টিয়া মেডিকেল হাসপাতাল চালুতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার চিকিৎসা যন্ত্রপাতি-সরঞ্জামাদি ক্রয়-আমদানি সমুদয় বুঝে নিলেও ৩৮ কোটি টাকার অডিট আপত্তি দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট ইউনিট। একই অনিয়ম অভিযোগ তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। স্পেসিফিকেশন শর্ত লঙ্ঘনসহ আমদানি যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন, পরিচালনা ও যথাযথ মান নির্ভুলতা যাচাই ছাড়া তা গ্রহণ করছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে স্থাপিত কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজটি অস্থায়ী ভবন থেকে ২০২২ সালের ৩ মার্চ ফিরে আসে মূল ক্যাম্পাসে। তবে হাসপাতাল ছাড়াই মূল ক্যাম্পাসে চালু হয় শুধু একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম।
অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ও হস্তান্তরিত কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন সাততলা হাসপাতাল ভবনটি তিনটি ব্লকে বিভক্ত। ১৬টি অপারেশন থিয়েটার, ৮৫টি আইসিইউ-সিসিইউ বেড ও ১৯টি লিফট সংযোজনসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্নের পরও শুধু যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন, পরিচালনা ও নির্ভুল সক্রিয়তা যাচাইকরণ জটিলতাণ্ডটানাপড়েনে ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালটি চালু হচ্ছে না। বিগত এক বছর ধরে শুধুই চলছে চিঠি চালাচালি। প্রকল্প পরিচালক ডাক্তার সারওয়ার জাহান আমদানি যন্ত্র বুঝে নিতে হাসপাতালের পরিচালককে বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড ও স্পেসিফিকেশন শর্ত লঙ্ঘন করে ক্রয় করা হয়েছে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি। ক্রয়কৃত ওই যন্ত্র প্রতিস্থাপন ও পরিচালনার পর যথাযথ মান যাচাইকরণ না হওয়ায় মেডিকেল কলেজের স্ব স্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা যন্ত্র গ্রহণে দিচ্ছেন না তাদের সম্মতি। ফলে হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার আনোয়ারুল ইসলাম আমদানি মেডিকেল যন্ত্রপাতি গ্রহণ করছেন না। এদিকে জাতীয় ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুপমেন্ট মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) জরিপে আমদানি যন্ত্রপাতির ২৫-৩০ ভাগ অগ্রণযোগ্য বলে ‘লগবুকে’ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করায় অনিয়মিত ব্যয় ৪ কোটি ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৯৭ টাকা। টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী, সিটিস্ক্যান ও এমআরই মেশিনসহ অন্যান্য কম্পোন্যান্ট না নেয়া সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিলের সমুদয় টাকা পরিশোধে অনিয়মিত ব্যয় ৩১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বাজার দরের তুলনায় অধিক উচ্চদামে এমএসআর সামগ্রী ক্রয়ে ৩১ লাখ ২২ হাজার টাকা ও মেডিকেল যন্ত্র বাক্সবন্দি ফেলে রাখায় ১ কোটি ৩১ লাখ ৫০ টাকাসহ মোট ৩৭ কোটি ৫৮ লাখ ৪১ হাজার ৩৯৭ টাকা ক্ষতি-অনিয়ম করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থিক ব্যবস্থাপনা ইউনিট (এফএমএইউ) অডিট আপত্তি দিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব এমডি কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক ডাক্তার সারওয়ার জাহানকে অডিট আপত্তির জবাব দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
অন্যদিকে কুষ্টিয়া দুদকের সহকারী পরিচালক নীল কমল পাল জানান, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়সংক্রান্ত অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের টিম (দুদক) ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করেছে। তথ্যউপাত্ত সংগ্রহসহ অনিয়ম অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে। যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়মে সরকারি কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের একাধিক চিকিৎসক ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার আক্রামুজ্জামান মিন্টু জানান, ক্রয়কৃত যন্ত্র প্রতিস্থাপন ও পরিচালনার পর যথাযথ মানসম্পন্ন রিপোর্ট পেলে সেগুলো গ্রহণের পক্ষে মতামত দেওয়া হবে। নিম্নমানের যন্ত্র গ্রহণে বিভাগীয় প্রধানরা সমর্থন দেবেন না বলে তিনি জানান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের প্রকল্প পরিচালক ডাক্তার সারওয়ার জাহান জানান, প্রকল্পের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় আমার দায়-দায়িত্বও শেষ। নিয়মনীতি অনুসরণ করেই টেন্ডারের মাধ্যমে মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়/আমদানি করা হয়েছে। এতে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে তার দাবি। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিযোগ্য বলে তিনি দাবি করেন। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডাক্তার এএইচএম আনোয়ারুল ইসলাম জানান, মেডিকেল যন্ত্রপাতি যাচাই-গুণমান সঠিকতা নিরূপণে আমার দক্ষতা নেই। যন্ত্র প্রতিস্থাপন ও পরিচালনার পর মেডিকেল কলেজের স্ব-স্ব বিভাগীয় প্রধানদের সম্মতি পেলে আমদানি যন্ত্রপাতি গ্রহণ করা হবে। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান খান জানান, যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগ শুনেছি। যন্ত্র স্থাপন জটিলতায় হাসপাতাল চালু না হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের ক্লিনিক্যাল ক্লাস ব্যাহতসহ এতদঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠী উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছে।