আমন ধানের চারা সংকটে দিশাহারা কৃষক

প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, মোরেলগঞ্জ

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের উপকূলীয় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে টানা বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমনের চারার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। রোপণের জন্য আমন খেত প্রস্তুত করেও মাঠ খালি রাখতে হয়েছে। এতে উপকূলীয় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের প্রধান ফসল আমন চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকে। মোরেলগঞ্জের কৃষি বিভাগও জানিয়েছে, এবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে সম্প্রতি প্রবল বৃষ্টিতে প্লাবিত হয় বাগেরহাটের নিম্নাঞ্চল। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে জেলার লক্ষাধিক মানুষ। ভেসে যায় শত শত পুকুর-মৎস্য খামার। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে জেলার লক্ষাধিক মানুষ। ভেসে যায় শত শত পুকুর-মৎস্য খামার। অবিরাম বৃষ্টিতে ফসলি জমি, বীজতলা, পানবরজসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। পানি নিষ্কাশনের পর দৃশ্যমান হতে থাকে ক্ষতির পরিমাণ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমনের বীজতলা। বীজতলা পচে ও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন করে দেখা দিয়েছে বীজ সংকট। জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহজুড়ে উপকূলীয় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ৪৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এ ছাড়াও আগস্ট মাসে প্রায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে আমনের বীজতলা ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকরা জানিয়েছেন, অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে বীজতলা তৈরি করেছিলেন যেসব কৃষক, তাদের চারা নষ্ট হয়নি। এসব বীজ কিনে আনছেন অনেকে। একসের আমন ধান থেকে যে চারা পাওয়া যায় তা ২০০ টাকা করে বিক্রি করছেন অনেক কৃষক; কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা কম। এতে অনেক জমি অনাবাদি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মোরেলগঞ্জে মোট ১৫ হাজার ৫৯০ জন চাষির মাধ্যমে এবার ২০ হাজার ৪৩৯ হেক্টর আমন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই লক্ষ্য নিয়ে বিআর-১১, বিআর-৫২ ও বিআর-২২ জাতের ধান চাষের জন্য ২০৩০ হেক্টর বীজতলা তৈরি করা হয়। কিন্তু অতিবৃষ্টিতে সব বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু মোরেলগঞ্জে নয়, রামপাল, মোংলা, শরণখোলাও অধিকাংশ এলাকায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। বীজ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি সহায়তা দাবি করেন এসব এলাকার কৃষক। বাগেরহাটের ৫৫ ভাগ জমিতে বি-আর, ব্রি ও বিনা—এই তিন জাতের উফশী ধান আবাদ করা হয়। বাকি ৪৫ ভাগ জমিতে আবাদ করা হয় স্থানীয় জাতের রোপা আমন।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, এ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে ‘টানা বর্ষণের ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় এ বছর আমনের সব বীজতলাই নিমজ্জিত হয়েছিল। অপেক্ষাকৃত নিচু বীজতলার প্রায় সব চারা নষ্ট হয়েছে। তবে কিছুটা উঁচু জমিতে তৈরি বীজতলার আংশিক ক্ষতি হলেও চারা রোপণের জন্য জমি তৈরি করতে এসব বীজ রোপণ উপযোগী হয়েছে। এবার আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নের ফুলহাতা গ্রামের কৃষক রাকিব হাসান বলেন, ‘আমনের জন্য আধকানি (২ একর) জমিতে বীজতলা করেছি। দেওইর (বৃষ্টি) কারণে আলচাষ (হালচাষ) করতে পারি নয়। এহন (এখন) পানি কমছে, চাষবাস কইররা জমিতে বীজ লাগামু; কিন্তু বীজ সব পইচ্চা নষ্ট অইয়া গ্যাছে। নতুন কইররা বীজ করারও সোমায় নাই। হেইতে খ্যাত খিল (অনাবাদি) থুইয়া দিছি।’

মোরেলগঞ্জনয়, রামপাল, মোংলা, শরণখোলায় ওইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, আমনের খেত চারা রোপণের জন্য প্রস্তুত করা হলেও চারার অভাবে মাঠ খালি পড়ে রয়েছে। একই অবস্থা জেলার পাথরঘাটা, বেতাগী ও বামনা উপজেলার আমন চাষিদেরও। শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের পশ্চিম রাজৈর গ্রামের চাষি মো. সাইয়েদ আলী জানান, ‘মোগো প্রায় দুই কানি (৩ একর) জমি এবার খিল (অনাবাদি) থাকপে। এত কষ্ট হরছি, এহন মাঠে ধান ফলাইতে পারতে আছি না। এর চাইতে মোগো আর কষ্ট থাহে না কিছু।’ বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার বলেন, ‘সরকারিভাবে কৃষকদের আমনের বীজ সরবরাহ করেছিলাম। বীজ বপনের সময় উঁচু জমি নির্বাচনের পরামর্শও দিয়েছি; কিন্তু এবার চারা নষ্ট হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। চেষ্টা করেছি কৃষকদের চারার সংকট কাটানোর জন্য। তবুও সংকট কাটেনি।’