পানগুছির ইলিশের স্বাদণ্ডগন্ধের জুড়ি নেই

ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না নিম্ন আয়ের মানুষ

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এসএম সাইফুল ইসলাম কবির, মোরেলগঞ্জ

বিশ্ব ঐতিহ্য পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ পূর্ব সুন্দরবনের উপকূলীয় বাগেরহাটের পানগুছি বলেশ্বর নদের ইলিশ। যেমন তার রূপ, তেমন তার স্বাদণ্ডগন্ধ। একটি ঐতিহ্যও বলা চলে এই বলেশ্বরের ইলিশকে। দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী, সাগরের মধ্যে পানগুছি বলেশ্বর নদের ইলিশই সেরা। বাজারে ইলিশের দামও বেশি। ইলিশ ধরাকে কেন্দ্র করে উপকূলের কয়েক হাজার জেলের কর্মসংস্থানও হয়েছে। তবে দাম বেশি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষগুলো ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না বলে জানা যায়। ইলিশের আসল স্বাদণ্ডগন্ধ পেতে চাইলে জুড়ি নেই বলেশ্বরের ইলিশের। এই রূপালি ইলিশের নাম শুনলেই জিভে জল চলে আসে ভোজন রসিকদের।

পদ্মার ইলিশের মতোই পানগুছি-বলেশ্বর নদের ইলিশেরও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা ও নামডাক। স্থানীয় ক্রেতা ছাড়াও বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ শরণখোলায় ছুটে আসেন এই বলেশ্বরের ইলিশের টানে। কিনে নেন কোনোরকম বরফের স্পর্শ ছাড়া তাজা ইলিশ। আবার অনেকে ঢাকা, খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত তাদের আত্মীয়-স্বজনদের জন্যও কিনে পাঠান সুস্বাদু এই ইলিশ। বলেশ্বরের ইলিশের নাম শুনলেই দামের দিকে তাকান না ইলিশপ্রেমীরা। পানগুছি বলেশ্বর নদে এখন প্রতিদিনই জেলের জালে ধরা পড়ছে মণকে মণ তরতাজা ইলিশ। দুপুরের পর থেকেই জেলেরা ভেজা কাপড়ে ইলিশ ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে ফেরেন আড়তগুলোতে। আর বিকাল হলেই আড়ত থেকে সেই ইলিশগুলো চলে যায় উপজেলা শহর রায়েন্দা বাজার, পাঁচরাস্তা প্রশাসন মার্কেট মাছ বাজারসহ বিভিন্ন হাটবাজারে। এসব ইলিশ আকার ভেদে দাম হাঁকিয়ে বিক্রি করে থাকেন মাছ ব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন-চারদিন ধরে প্রচুর বড় ইলিশ ধরা পড়ছে বলেশ্বরে। রুপালি ইলিশের ঝিলিকে হাসি ফুটেছে জেলেদের মুখেও। ৮-৯শ’ গ্রাম থেকে শুরু করে দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ অহরহ উঠছে জেলের জালে। এর মধ্যে বেশিরভাগই মা’ ইলিশ।

তবে, প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও এর দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। যে কারণে বড় ইলিশের স্বাদ নিতে পারছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। বলেশ্বর নদে জেলের জালে হঠাৎ ইলিশ ধরা পড়ার কারণ হিসেবে মৎস্য বিভাগ জানায়, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। আবহাওয়াও অনুকূলে। তাই বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসছে ইলিশের ঝাঁক। তাছাড়া, কিছুদিন বাদেই ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম শুরু হবে। এজন্য মা ইলিশগুলো সাগর থেকে ঝাঁক বেঁধে মিঠা পানির শাখা নদ-নদীতে চলে আসছে। যা ধরা পড়ছে জেলের জালে। উপজেলা মোরেলগঞ্জে শহরের মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ব্যবসায়ীরা রুপালি ইলিশের পসরা সাজিয়ে বসেছেন।

একেক জনের ডালায় ২০-৩০ কেজি করে বড় সাইজের ইলিশ। প্রত্যেকটি ইলিশের পেটেই ডিম বোঝাই। ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। দাম যাচাই-বাছাই করে বনিবনা হলে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের পছন্দসই ইলিশ। মোরেলগঞ্জে মাছ বাজারের ব্যবসায়ী কমিশনার ইউনুস সরদার.আব্দুল আউয়াল মাতুব্বর. লাভলু শেখ সোহাগ হাওলাদার, খোকন হাওলাদার, আউয়াল, রাসেল হাওলাদার জানান, গত তিন-চারদিন ধরে পানগুছি বলেশ্বরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে।

সাইজও বেশ বড়। এর আগে ছোট ইলিশ (জাটকা) ধরা পড়তো। তাও পরিমানে কম। বর্তমানে ৮-৯শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, এক কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৬০০টাকা এবং দুই কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার ৮০০টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা দরে কেজি বিক্রি হচ্ছে।

এসব ব্যবসায়ীরা জানান, দাম যতোই হোক না কেন কোনো ইলিশই অবিক্রিত থাকে না। স্থানীয়দের পাশাপাশি তাদের আত্মীয়-স্বজনদের জন্যও ইলিশ কিনে নেন তারা। ককসিট ভরে বলেশ্বরের ইলিশ পাঠান দূর-দূরান্তের স্বজনদের কাছে।

বলেশ্বর নদের জেলে সোহেল শাহ, রাসেল হাওলাদারসহ অনেকেই জানান, কয়েকদিন আগেও সারা দিন জাল ফেলে দেড়-দুই কেজি জাটকা উঠতো। এখন বড় ইলিশ উঠছে। প্রতিদিন একেকজন জেলে ৮-১০ কেজি করে বড় ইলিশ পাচ্ছেন। এসব ইলিশ তাদের নির্ধারিত আড়তে বিক্রি করেন। এখন জেলে-মহাজন-ব্যবসায়ী সবাই লাভে আছেন।

গতকাল মোরেলগঞ্জ মাছ বাজারে ইলিশ কিনতে এসেছিলেন জাহিদুল ইসলাম। তিনি দেড় কেজি ওজনের দুটি ইলিশ কিনেছেন। ১৬শ’ টাকা কেজি দরে দুটি ইলিশের দাম পড়েছে চার হাজার ৮০০ টাকা। ওই ক্রেতার কাছে জানতে চাইলে বলেন, দাম কোনো বিষয় না। বলেশ্বরের ইলিশ আমার খুব পছন্দ। তাই কিনে নিলাম।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য নদ-নদীর চেয়ে বলেশ্বর নদের ইলিশের স্বাদণ্ডগন্ধ একটু আলাদা। ইলিশের চেহারা-আকারও ভিন্ন। বেঙ্গাপসাগরের ইলিশের তুলনায় পেটি খুব চওড়া। প্রচুর তেলও এই ইলিশে। যে কারণে দাম ও চাহিদা বেশি। এখন সময় এসেছে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের। আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলিশ ধরার জন্য জেলেদের বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করছি।

মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় আরো বলেন, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় ইলিশের জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। যে কারণে সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ শাখা নদ-নদীতে উঠে আসছে। তাই জাল ফেললেই ধরা পড়ছে বড় ইলিশ। তাছাড়া, অক্টোবর মাসে শুরু হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এ সময় ২২ দিন দেশের সকল নদ-নদী ও সাগরে ইলিশসহ সকল প্রকার মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকবে। প্রজনন মৌসুম আসন্ন হওয়ায় এখন সব ইলিশের পেটে ডিম থাকাটাই স্বাভাবিক। ডিমছাড়া ও ডিমওয়ালা ইলিশ চিনবেন যেভাবে-

এ ধরনের ইলিশ চেনার জন্য কিছুটা অভিজ্ঞ হতে হবে। আগস্ট মাসের দিকে ইলিশ ডিম ছাড়তে শুরু করে। এই মৌসুম চলে সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর পর্যন্ত। সাধারণত ডিমওয়ালা ইলিশ চ্যাপ্টা আকৃতির হয়। এ ধরনের ইলিশের পেট টিপলে পায়ুপথের ছিদ্র দিয়ে ডিম বের হয়ে আসে। অপরদিকে ডিম ছাড়া ইলিশের পেট অনেকটা ঢিলে হয়। কোন ধরনের ইলিশ কিনবেন না?

ইলিশ মূলত এর স্বাদের জন্য বিখ্যাত। ইলিশের স্বাদ পুরোপুরি পেতে চাইলে বড় ইলিশ কিনতে হবে। তাই ছোট ইলিশ কিনবেন না। এ ধরনের ইলিশে স্বাদ কম হয়। আবার যেসব ইলিশ দীর্ঘদিন ফ্রিজে থাকে সেগুলোরও স্বাদ কমে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়।

যে ইলিশ কম চকচকে থাকে, সেগুলোই বেশিদিন ফ্রিজে রাখা। এভাবে দেখেও চিনে নিতে পারেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাগেরহাটের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ইমরা জানান, ইলিশের দাম ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্য আনতে মাঠে নামছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার অধিদপ্তর। সংস্থাটি ইলিশের বাজার নিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে শিগগিরই মাঠে নামবে সংস্থাটি।