জেলা পরিষদের ডাকবাংলো সরকারি কর্মকর্তাদের দখলে

অনুসন্ধানে অনিয়ম দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এসএম রায়হান, ঝিনাইদহ

ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ পরিষদের ডাকবাংলোগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের দখলে। মাসের পর মাস থাকেন অত্যাধুনিক ভিআইপি কক্ষে। ভাড়া দেন (নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে) অর্ধেক। কোন ব্যক্তি আবার এক টাকাও ভাড়া দেন না। কেয়ারটেকারের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

অনুসন্ধানে মিলেছে অনিয়ম-দুর্নীতির ভয়াবহ সেই চিত্র। জেলা সদর ডাকবাংলোর ঝিনাইদহ জেলা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে সরকারি কেসি কলেজের দক্ষিণ অবস্থিত। বিগত তিন বছরের রেজিস্টার খাতা (২০২২-২৩ ও ২০২৪ ) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বাংলোর নতুন ভবনে রয়েছে ৪টি ভিআইপি কক্ষ (রুম)। কেয়ারটেকার মেহেদেী হাসান জানান, বাংলোর একটি কক্ষ সর্বক্ষণ রিজার্ভ রাখা হয়। বাকিগুলো ভাড়া দেয়া হয়। তার (মেহেদী) দেয়া তথ্য মতে সব শেষ ২০১৭ সালের ১৯ জুন বাংলোর কক্ষ (রুম) ভাড়া নির্ধারণ করে চার্ট (তালিকা) প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই চার্টে স্বাক্ষর করেছেন জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান কনক কান্তি দাস (জেলা আওয়ামী লীগ নেতা) ও সচিব (জেলা পরিষদ) মুহাম্মদ রেজা আরিফিন সরকার। ওই তালিকা মোতাবেক জেলা সদরের বাংলোর ভাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ভিআইপি এসি রুম প্রতি দিন ৪০০ টাকা, নন এসি (ভিআইপি) ২০০ টাকা, দুই সিট (বেড) বিশিষ্ট কক্ষ প্রতি সিট ১৫০ টাকা। উপজেলা বাংলোগুলোতে (সরকারি কর্মকর্তা) এসি কক্ষ (ভিআইপি) প্রতিদিন ৩০০ টাকা, নন এসি (ভিআইপি) ২০০ টাকা (প্রতিদিন) এবং দুই সিট বিশিষ্ট কক্ষ প্রতি সিট ১৪০ টাকা।

বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সেক্টর কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা রেটে ভাড়া আদায়ের বিধান রয়েছে। জেলা পরিষদের প্রধান সহকারী (বড়বাবু) আনোয়ার হোসেন জানান, একজন কর্মকর্তা ডাকবাংলোতে টানা তিন দিনের বেশি অবস্থান করলে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় করার বিধান রয়েছে। রেজিস্টার খাতায় দেখা যায়, ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল ঝিনাইদহের (সদর হাসপাতাল) সদ্য অপসারিত তত্ত্বাবধায়ক ডা: সৈয়দ রেজাউল ইসলাম নতুন ভবনের (জেলা সদর বাংলোর) ভিআইপি এসি ৩ নাম্বার কক্ষে থাকেন। ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ওই কক্ষ ভাড়া নিয়েছেন তিনি (তত্ত্বাবধায়ক)। প্রতি মাসে ভাড়া প্রদান করেছেন মাত্র ৬০০০ হাজার টাকা। হিসাব মতে ২০০ টাকা হারে প্রতি দিন ভাড়া দিয়েছেন তিনি। চলতি (২০২৪) সেপ্টেম্বর মাসেও ওই কর্মকর্তা (তত্ত্বাবধায়ক) কক্ষটি দখলে রেখেছেন। প্রতিদিন ৪০০ টাকা হারে (মাসে ১২ হাজার টাকা) তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ সৈয়দ রেজাউল ইসলামের কাছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পাওনা হয়। অথচ ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ওই কর্মকর্তা মাসিক ছয় হাজার টাকা হিসাবে ভাড়া প্রদাণ করেছেন। নির্ধারিত (প্রতি দিন চারশত) ভাড়ার অর্ধেক (দুইশত টাকা) দিয়েছেন তিনি। ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে তার (ডাঃ রেজাউল) কাছে।

অপরদিকে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো: শওকত হোসেন ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত জেলা সদর ডাকবাংলোর এক নাম্বার ভিআইপি এসি কক্ষে অবস্থান করেছেন। ওই সময়ে ৪০০ টাকার পরিবর্তে প্রতিদিন ২০০ টাকা হারে ভাড়া প্রদান করেছেন তিনি। অপর এক কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: আবু রাসেল ২০২১ সালের ৯ জুন থেকে ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (একই ডাকবাংলো) ভিআইপি ২ নাম্বার এসিরুমে থেকেছেন। কেয়ার টেকার মেহেদীর দেয়া তথ্য মতে এক টাকাও ভাড়া প্রদান করেননি পুলিশের এ কর্মকর্তা।

বাংলোর সাবেক কেয়ারটেকার বাবুল (বর্তমান হরিণাকুন্ডু) অভিযোগ করেন, ভাড়া চাওয়া মাত্র মাদক দিয়ে চালান করে দেওয়া হুমকি দিয়েছিলেন তিনি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপর)। জেলা পরিষদের দেওয়া তথ্য মতে ঝিনাইদহ জেলার ৬ উপজেলায় ৬টি ডাকবাংলো রয়েছে। সে গুলোর মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ, তৈজষপত্র ক্রয় এবং কেয়ারটেকারদের বেতন খাতে প্রতিবছর খরচ হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন সময়ে বাংলোগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। কেয়ারটেকারের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। সেই হিসাবে ৬ জন কেয়ারটেকারের এক বছরে বেতন ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। বিপুল অংকের এই টাকা জেলা পরিষদকে প্রদান করতে হয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে যে ভাড়া আদায় করা হয় তাতে একজন কেয়ারটেকারের বেতনও হয় না। জেলা সদরের (সরকারি কেসি কলেজের সামনে) বাংলোটি অত্যাধুনিক। সেখানে পুরাতন একটি দ্বিতল ভবন (১১টি কক্ষ) এবং নতুন একটি দ্বিতল ভবন (কক্ষ ৪টি) রয়েছে। কোট চাঁদপুরের উপজেলা শহরের বাংলোটি সদ্য বিলুপ্ত জাতীয় সংসদের ঝিনাইদহ-৩ (কোটচাদপুর-মহেশপুর) আসনের সাবেক এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সালাউদ্দিন মিয়াজীর ব্যক্তিগত অফিস গড়ে তুলেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে বাংলো ছেড়ে চলে গেছেন সাবেক ওই এমপি। আজো ভাড়া নেয়া হয়নি তার কাছ থেকে।

এ বিষয়ে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (উপ-সচিব) সেলিম রেজা বলেন, বিনা ভাড়ায় থাকা কিংবা অর্ধেক ভাড়া দেয়ার কোনো বিধান নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে বকেয়া ভাড়া পরিশোধের জন্য শিগগিরি চিঠি দেয়া হবে। বিধি মোতাবেক পাওনা আদায় করা হবে।