দেশের অন্যতম গাজর উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে পরিচিত পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা। এই এলাকার মাটি ও আবহাওয়া গাজর উৎপাদনের উপযোগী হওয়ায় একই জমিতে বছরে তিনবার গাজরের ফলন হয়। এখানকার গাজর স্বাদ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ হওয়ায় চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে স্যাংগাল গাজরের বীজ ২০ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ২০০ থেকে ২৬ হাজার পর্যন্ত। হঠাৎ বাজারে জাপানের বীজ কোম্পানির স্যাংগাল গাজর বীজের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। ডিলারের সঙ্গে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একশ্রেণির ব্যবসায়ী রাতারাতি স্যাংগাল গাজরের বীজের দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে গাজরের বীজ বিক্রি হয়েছে।
পাবনার ‘গাজর গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত ভাড়ইমারী গ্রামে সরেজমিন দেখা যায়, অর্ধশতাধিক কৃষক গাজরের বীজের দাম বাড়ার কারণ নিয়ে আলোচনা করছেন। তারা জানান, ২০১০ সালে জাপানের স্যাংগাল কোম্পানির গাজরের বীজ ঈশ্বরদীতে বেচাকেনা শুরু হয়। ওই বছর থেকেই এখানকার মানুষ স্যাংগাল বীজ বপন শুরু করেন। এ বীজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এক বিঘা জমিতে ৭০০-৮০০ গ্রাম বীজ বপন করলেই যথেষ্ট। যেখানে অন্য কোম্পানির বীজ লাগে এককেজি।
স্যাংগাল বীজের ফলন ও পুষ্টিগুণ ভালো হয়। তাই স্যাংগাল কোম্পানির বীজ বপন করে আসছেন ঈশ্বরদীর কৃষকরা। বছরে তিনবার একই জমিতে এই বীজ বপন করে গাজর উৎপাদন করে আসছেন তারা। বিশেষ করে আগাম ও মধ্যম ফসলের সময় স্যাংগাল বীজ বেশি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া অনেকেই নাবি (তৃতীয় ধাপ) গাজর চাষের সময়ও স্যাংগাল কোম্পানির বীজ ব্যবহার করেন।
ভাড়ইমারী গ্রামের আনন্দবাজার এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতেই স্যাংগাল গাজর বীজের প্রতিকেজি বাজারমূল্য ছিল ২০ হাজার ২০০ টাকা। এক সপ্তাহ পর থেকেই দাম ২৫ হাজার থেকে ২৭ হাজার টাকায় বেচাকেনা শুরু হয়। ডিলারের কারসাজির কারণে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা এখন ইচ্ছা অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করার চেষ্টা করছেন।
কৃষক রোকন হোসেন বলেন, ডিলাররা বলছেন স্যাংগাল কোম্পানির বীজ মার্কেটে নেই। কিন্তু বেশি টাকা দিলেই ডিলার একদিন পর অথবা কয়েক ঘণ্টা পরে বীজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
আনন্দবাজার এলাকার কৃষক বিপুল হোসেন বলেন, আমরা প্রতিবছরই স্যাংগাল কোম্পানির বীজ বপন করি। এবার ডিলারের সঙ্গে যোগসাজশ করে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের তুলনায় এখন কেজিপ্রতি ৫-৬ হাজার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
স্যাংগাল বীজের আমদানিকারক ঢাকার সিদ্দিক বাজারের মাসুদ সীড কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি রাজু হোসেন বলেন, এদেশে স্যাংগাল কোম্পানির গাজর বীজের চাহিদা ৮০০০ কেজি। এবার এ পর্যন্ত ১৫০০ কেজি আমদানি করা গেছে। দাশুড়িয়ার ডিলারকে ৫০০ কেজি বীজ সরবরাহ হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় চাহিদা বেশি থাকায় এটি পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া এবার প্রতিকেজি গাজরের বীজের দামের খুচরা মূল্যে ২০ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
স্যাংগাল গাজর বীজের দাশুড়িয়ার ডিলার মেসার্স সাখাওয়াত ট্রেডার্স ও দাশুড়িয়া বীজ ভাণ্ডার। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আব্দুল মালেক বলেন, আমাদের এলাকায় স্যাংগাল কোম্পানির গাজর বীজের চাহিদা প্রায় দুই টন। পেয়েছি মাত্র ৫০০ কেজি। আমার কাছে যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ কোম্পানির নির্ধারিত দামেই বিক্রি করেছি।
কৃষকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার কাছে গাজরের কোনো বীজ নেই। অন্য ব্যবসায়ীরা বাইরের জেলা থেকে এনে ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করছেন। এতে আমার কিছু করার নেই।
পাবনার কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জানান, ঈশ্বরদীতে প্রতিবছর ৮০০ হেক্টর জমিতে আগাম গাজরের চাষ হয়। এবার আগাম গাজরের চাষ শুরু হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকদিন আগে দাশুড়িয়া বাজারের বীজের দোকানে অভিযান চালানো হয়। এ সময় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। ন্যায্য মূল্যে গাজরের বীজ সরবরাহে ব্যবসায়ীদের প্রতি কঠোর নিদের্শনা দেয়া হয়েছে।