ভালো নেই শহীদ রাজিবের পরিবার
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শওকত আলী, চাঁদপুর
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধান মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে দেশে তার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকতে না পেরে পালিয়ে ভারতে চলে যান। এ আন্দোলনের শুরুতে দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে একমত হয়ে আন্দোলনে সামিল হন, চাঁদপুর মতলব এলাকার বাসিন্দা গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় ভাঙারি দোকানের কর্মচারী আরিফ হোসেন রাজিব (২৯)।
রাজিব গত ২০ জুলাই গাজীপুর বোর্ডবাজার আইইউটি গেট এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তারই শিশু পুত্র ইব্রাহীম, স্ত্রীসহ পুরো পরিবারের সবাই এখনও শোকাহত দিন কাটছে। রাজিব চাঁদপুর জেলাধীন মতলব উত্তর উপজেলার গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজ গ্রামের রজ্জব আলীর ছেলে।
সরেজমিন রাজিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ ঘরের সামনে বসে আছেন পরিবারের সদস্যরা। রাজিবের বাবা রজ্জব আলী পেশায় ছিলেন কৃষক। তবে গত কয়েক বছর আগে কাজে গিয়ে ডান হাত অকেজো হয়ে পড়েন। সেই থেকে তিনি কাজ করতে অক্ষম। মা আমেনা বেগম গৃহিণী। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজিবের চার বোন। ভাই বোনদের মধ্যে রাজিব দ্বিতীয়। সবার বড় বোন মনি আক্তার, ছোট বোন নুরজাহান, মুক্তা ও মীম। মীম ছাড়া বাকি তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই শরীফ বয়স ১৭। সে বোন মুক্তার সঙ্গে গাজীপুর একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। রাজিবের মৃত্যুর পর পরিবারের অনেকেই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। আরিফের বাবা-মা এক সময় পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা জেলার হোমনায় থাকতেন। সেখানে আমেনা বেগম মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন।
গত প্রায় এক যুগ ধরে নিজ বাড়ি মতলবে চলে আসেন তারা। রাজিবের মৃত্যুর বর্ণনা দিলেন ছোট বোন মুক্তা ও ভাই শরীফ। মুক্তা বলেন, পোশাক কারখানায় কাজ করার কারণে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। সেখানে গিয়ে ভাঙারি দোকানে কাজ নেন ভাই রাজিব। দোকান মালিক থেকে টাকা নিয়ে ভাঙারি কিনে আনতেন। তার আয়েই চলছিল বাবা-মার সংসার। ঘটনার দিন ২০ জুলাই বিকেলে কাউকে না জানিয়ে কাজ রেখে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যায়। সেখানে আইইউটি গেটের সামনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। ওই স্থানেই পেটে গুলিবিদ্ধ হন রাজিব।
ভাইয়ের পরিচিত ফজলু নামে এক ব্যক্তি আমাকে ফোন দিয়ে জানান তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। রাজিবের স্ত্রী শরীফা বেগম বলেন, তার বাবা রাকিব মিয়া (৫৫) পেশায় আইসক্রিম বিক্রেতা। মা নাছিমা আক্তার (৪০) গৃহিণী। ঘটনার দিন তার স্বামী রাজিব কাজে বের হয়ে যান। এরপর আর কথা হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রথমে যোগ দেয়নি। কিন্তু গাজীপুরে বোর্ডবাজার এলাকায় প্রথমেই আন্দোলন শুরু হয় ২০ জুলাই। ওইদিনই তিনি আন্দোলনে যান। সেখানে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। রাজিবের বাবা রজ্জব আলী কথা কম বলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবং ছেলেকে হারিয়ে তিনি শোকাহত। কারণ ছেলের আয় রোজগারে চলতো তাদের সংসার। বাড়িতে রাজিবের মা, ছোট বোন মীমসহ থাকতেন। ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত মা আমেনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে আমার দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ছোট বেলা থেকে রিকশা চালিয়ে সংসারে খরচ দিয়েছে।
এরপর এলাকায় ভাঙারি দোকানে কাজ করেছে। মেয়ে মুক্তার বিয়ের পরে গাজীপুরে চলে যায়। বিয়ের পর বউকে নিয়ে বাড়িতে ছিল প্রায় দেড় বছর। আয় রোজগার কম হওয়ায় গাজীপুর চলে যায়। কিছুদিন পূর্বে আমার স্বামী গাজীপুর গেলে ছেলে আমার নাতিকে মাদরাসায় পড়ানোর জন্য অনুরোধ করে এবং নাতিকে দাদার হাতে তুলে দেয়। তখনই তার কথাগুলো আমাদের সবাইকে ব্যথিত করে। তিনি আরো বলেন, ছেলের মৃত্যৃর পরে এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারাও এসে খোঁজ খবর নিয়েছেন। আমাদের কোনো সামর্থ্য ছিল না ছেলের জন্য কোনো আয়োজন করার। তবে সরকারিভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নগদ ১০ হাজার টাকা এবং কিছু ফল দিয়ে গেছেন। আমেনা বেগম বলেন, ছেলেকে হারিয়ে আমরা এখন দিশাহারা। ছেলের বউ, নাতি এবং আমার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে সংসার চলার অবস্থা নেই। ছোট ছেলেও কাজ হারিয়ে বেকার রয়েছে।