উন্নয়নবঞ্চিত গ্রাম নয়াচর সবক্ষেত্রেই পিছিয়ে

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তাজুল ইসলাম, তিতাস (কুমিল্লা)

কুমিল্লার তিতাসে প্রত্যান্ত অঞ্চলে প্রায় একশ বছর আগে গড়ে উঠা নয়াচর গ্রামটি উন্নয়নবঞ্চিত। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এ গ্রামে বাল্যবিবাহের হার ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে ৪ কিলোমিটার দূরে ভোটকেন্দ্রে ভোট প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে ওই গ্রামের অধিকাংশ ভোটার। পিছিয়ে পড়া এ গ্রামের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এ যেন উন্নয়নের নামে ফুলঝুড়িতে বঞ্চনার এক উদাহরণ।

যোগাযোগ : একশ বছর আগে গড়ে উঠা কুমিল্লার তিতাস উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের অবহেলিত গ্রাম নয়াচর। প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা আধা কিলোমিটারের বেশি প্রস্থ গ্রামটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। নারান্দিয়া সুইচ গেইট থেকে মৎস্য প্রকল্পের পাড় দিয়ে একটি সড়ক থাকলেও সেটি গ্রামের প্রথম অংশ হিরা লালের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। নয়াচর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বারামবাড়ি আরামবাড়ি হয়ে খলিলাবাদ পর্যন্ত পায়ে হাটার রাস্তা থাকলেও বারামবাড়ি সামনে খালের উপর বিশ বছর আগে একটি সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হলেও সরকার পরিবর্তনের কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এটি ব্যবহারের অনুপোযোগী। গ্রামের অধিকাংশ মানুষকে খালের পাড় দিয়ে অথবা বাড়ির উঠান ব্যবহার করে যেতে হয়ে নিজ গৌন্তব্যে।

শিক্ষা : শিক্ষা অর্জন থেকে পিছিয়ে থাকা নয়াচর গ্রামের শিক্ষার আলো জ্বালাতে ১৯৯৪ সালে একই গ্রামের দানবীর ফুল মিয়া ব্যাপারী ও পার্শ্ববর্তী খলিলাবাদ গ্রামের হাজী করম আলী স্কুল নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। এর পর গ্রামের মাঝমাঝি স্থানে একতলা স্কুল ভবন নির্মাণ করা হয়। উক্ত ভবনের ছোট ছোট তিনটি কক্ষে দুই শিফটে চলে খুদে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। প্রাথমিক গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণে উক্ত গ্রামের শিক্ষার্থীদের অনিহা দেখা গেছে। যার মূল কারণ হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। ওই গ্রামের যদি কোন ব্যক্তি পড়াশোনা করতেন তাহলে তাকে যেতে হতো ৭ কিলোমিটার দূরে জুনাব আলী উচ্চ বিদ্যালয় কিংবা নারান্দিয়া কলিমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। অথবা ৬ কিলোমিটার দূরে মুরাদনগর উপজেলার পাঁচপুকুরিয়া বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে। বর্ষায় নৌকার ভোগান্তি আর শুষ্ক মৌসুমে জমির আইল (পাড়) দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেটে যাওয়ার প্রতিবন্ধিকতায় পেছিয়ে পড়ে যায় নয়াচর গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা। বিশেষ করে এই গ্রামের নারী শিক্ষার হার খুবই নগন্য।

বাল্যবিয়ে : স্থানীয়দের মতে, বর্তমানে নয়াচর গ্রামে প্রায় ছয়শ পরিবারের দুই হাজার লোক বাস করে। এদের মধ্যে অর্ধেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ায় গ্রামে বাল্যবিবাহের প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৫টি পরিবারের গড়ে তিনটি কন্যা সন্তান বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। নয়াচর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি নায়েব আলী জানান, একটা সময় ছিল এ গ্রামের মানুষের শিক্ষা গ্রহণ করা ছিল বিলাসিতা। আজকে থেকে ত্রিশ বছরে আগে এ গ্রামের কোন শিক্ষিত লোক ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাগালের মধ্যে না থাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে নয়াচর গ্রাম। হাতে গুনা দুয়েকজন মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করলেও নারীদের নিরাপত্তা ও দূরে স্কুল হওয়ায় এই গ্রামে নারী শিক্ষা একে বারে নাই বললেই চলে।

সত্তোর্ধ নারী আয়েশা বেগম বলেন, ৪০-৪৫ বছর হবে এ গ্রামে এসেছি। শুধু মাত্র একবার এমপি নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। রাস্তা-ঘাট না থাকায়; ভোট কেন্দ্র আরেক গ্রামে হওয়ায় আর ভোট দিতে যাই নাই। রাস্তা না থাকায় এ গ্রামের অনেক মহিলা ভোট কেন্দ্রে যায় না। নারান্দিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুজ্জামান খোকা বলেন, নারান্দিয়া ইউনিয়নের অবহেলিত গ্রাম নয়াচর এটা মেনে নিতে পারলাম না, আপনি বলতে হবে নয়াচর গ্রাম তিতাস উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত গ্রাম। স্বাধীনতা সংগ্রাম বাদ দেন, উপজেলা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অনেকে জনপ্রতিনিধি হয়েছে কেউ এ গ্রামের উন্নয়নে এগিয়ে আসেনি। আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর নয়াচর গ্রামের যাতায়াতের জন্য একাধিক রাস্তা আইডিভুক্ত করেছি। একটি সেতু নির্মাণে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে, আমি বিশ্বাস করি গ্রামে বাল্যবিবাহরোধ, শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ জীবন মানের উন্নয়ন হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমাইয়া মমিন বলেন, আমি সরেজমিন গ্রামটি পরিদর্শন করবো। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে, কিভাবে গ্রামটিকে আধুনিকায়ন করা যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।