ঢাকা ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কেঁচো সার উৎপাদনে স্বাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা

কেঁচো সার উৎপাদনে স্বাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা

পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত গারো মান্দি কোচ নারীরা যুগ যুগ ধরে কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। সংসারের যাবতীয় কাজ নারী পুরুষ মিলেই করে থাকে। জমিতে ধানের চারা রোপণ, ধান কাটা, বাড়িতে আনা নেয়া বাগান নিড়ানি বাগান করা সবজি চাষ থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজগুলো মিলে মিশে করার দৃশ্য নজর কাড়ে সবার। এখন বাড়িতে জৈব সার তৈরিও হচ্ছে নারীদের হাতে। সরকারের পাশাপাশি এএলআরডি, কারিতাস, সালোমসহ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নারীদের কৃষি কাজের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করতে বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ, ফলের চারা লাগানো, হাঁস মুরগি পালনসহ কেঁচো জৈব সার তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করছে। প্রশিক্ষণসহ কেঁচো বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এভাবে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের ভুটিয়া, আমলিতলা, গাছাবাড়ি, ইদিলপুর, রাজাবাড়ি, গায়রা, টেলকি, পীরগাছাসহ কয়েক গ্রামে এখন চলছে কেঁচো জৈব সার তৈরি। জৈব সারের চাহিদা থাকলেও ভালো দাম পাচ্ছে না তারা। খুচরা দামে বাড়ি থেকে বিক্রি হলেও সেলস সেন্টার না থাকায় পাইকারি বিক্রি করতে না পারায় ন্যায্য দাম পাচ্ছে না বলে মনে করছেন এ নারী উদ্যোক্তারা। তাদের দাবি সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা আরো এগিয়ে যাবে, পাবে ন্যায্য মূল্য। বেকারত্ব দূর হবে বাড়বে জৈবিক উপায়ে ফল ফসলের চাষাবাদ এমনটাই মনে করেছেন তারা। তবে কৃষি বিভাগ বলছে কেঁচো সার উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে। মধুপুর উপজেলার অরণখোলা ইউনিয়নের ভুটিয়া গ্রামে গিয়ে জানা যায়, কোচ নারীদের কেঁচো দিয়ে জৈব সার উৎপাদনের গল্প। নারীরা জানালেন, এ কাজে বাড়তি শ্রম না থাকায় নিজেরাই জৈব সার প্রক্রিয়া করে থাকে। পুরো প্রক্রিয়াই নারীদের হাতে। এ গ্রামে এক সময় তাদের বসবাস বেশি থাকলেও এখন মাত্র ৪০-৫০ পরিবারের বসবাস। বাঁশ বেতের পেশা থাকলেও উপকরণের দাম বৃদ্ধি ও প্লাস্টিকের দাপটের কারণে এ পেশা ছেড়ে কেউ কৃষি, কেউ দিন মজুরি আবার কেউ ভ্যান-রিকশা চালানোর কাজ করে। নারীরা বাড়ির কাজ আবার কেউ দিন মজুরি করে। কয়েক বছর আগে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় এ মৃ এএলআরডি নামক সংস্থা থেকে ভুটিয়াসহ কয়েকটি গ্রামে নারীদের কেঁচো পালনের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে কেঁচো দেন। তারপর থেকে তাদের গ্রামে কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরি শুরু। কয়েক বছর আগে অনেকেই করলেও এখন হাতে গোনা ৫-৭ জন নারী ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। বসত বাড়ির আশপাশে চারি, বালতি, রিংসহ নানা উপকরণে নিজের গোয়ালের গোবর দিয়ে কেঁচোর মাধ্যমে সার তৈরি করে। কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরি করতে প্রায় এক মাসের মতো সময় লাগে। এ সার তারা স্থানীয় কৃষকদের কাছে ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা মন দরে বিক্রি করতে পারেন। এমনটাই জানালেন গ্রামের কয়েকজন উদ্যোক্তা। গৌরি রানী বর্মন (৪০) জানান, তার ১০-১২ চারি জৈব সার রয়েছে। এ থেকে যে সার আসে, তা নিজেদের জমিতে প্রয়োগের পর বাড়তি সার বিক্রি করে দেন। সার বিক্রির টাকা সংসারের কাজে ব্যয় করেন। এতে তিনি ভালোই লাভ পাচ্ছেন। প্রমিলা রানী (৪২) জানালেন, বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে দুই একবার সময় দিয়ে থাকেন। ঘরের বারান্দায় কেঁচো সার উৎপাদনের রিং থাকায় যেকোনো সময় দেখতে পারেন। তিনি জানালেন বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে কিছু সার পেয়ে নিজের কাজে লাগান। আবার বিক্রি করে কিছু টাকাও পান। এতে সন্তানদের পড়াশোনা, নিজের হাত খরচ চালাতে কোন সমস্যা হয় না। শুধু ভুটিয়াই নয় মধুপুরের আরো কয়েক গ্রামে নারীরা করছে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি। এতে একদিকে নারীদের কিছুটা অর্থনৈতিক লাভ হচ্ছে। অন্য দিকে মাটিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ছে। মাটির গুনাগুন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে ফসলের ফলন। গারো নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং বলেন, গারো কোচ নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন করে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর বিক্রি করছে। এতে সংসারে স্বামীকে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজের ছোট খাটো খরচ চালানো সহজ হয়।

কারিতাসের টেলকি বাজারের আইসিটি সেন্টারের তন্দ্রা দালবত জানালেন, কারিতাসের প্রকল্পের মাধ্যমে জৈব সার নিরাপদ সবজি উৎপাদনে তারা কাজ করেন। তাদের এলাকায়ও কয়েকজন গারো মান্দি নারী এ সার উৎপাদন করে। টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, মাটির সুস্বাস্থ্যের জন্য জৈব সার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জৈব সার ব্যবহারের ফলে মাটির ঊর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। আমরা উৎপাদনকারীদের পরামর্শ ও টেকনিকাল সহযোগিতা দিয়ে থাকি। নারীরা নিজের সংসারের কাজের পাশাপাশি কেঁচো জৈব সার উৎপাদন করে নিজে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মধুপুর গড়ের কৃষি জমির ঊর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। নারীরাও এগিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত