মৌসুমী ইলিশ ব্যবসায়ীরা ইলিশ মৌসুমে কম মূল্য বড় ও মাঝারি আকারের ইলিশ ক্রয় করে নাড়িভুঁড়ি ও আঁশ ছাড়িয়ে নেয় এবং কেটে পিস, পিস করে পরিষ্কার করে। এর পর সামুদ্রিক বা মোটা লবন দিয়ে কিছুদিনের জন্য টিনের জারে তা প্রক্রিয়াজাত করে। পরে ইলিশ মৌসুম শেষ হলে তা খোলা বাজারে অধিক মূল্য বিক্রি করে। এ ছাড়াও ভোজন রসিক গৃহস্থরা দৈনন্দিন খাবারে অথবা অতিথি আপ্যায়নেও এ নোনা ইলিশ পরিবেশন করে থাকে। যা ঘ্রাণ ও স্বাদে অতুলনীয় এবং প্রটিনে সমৃদ্ধ। ইলিশ মাছ প্রজন শেষে গভীর নদী ও সাগরে চলে যাওয়ায় জেলে পল্লীতে বর্তমানে চলছে ইলিশের আকাল। আর এ ইলিশ সংকটে জেলার বিভিন্ন এলাকাগুলোতে ঐতিহ্যবাহী এই নোনা ইলিশ বা কাটা ইলিশ আগের মতো এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
ভোলার খাল এলাকার ইলিশ আড়তদার নাছির মাঝি বলেন, বিগত বছরগুলোতে জেলে পাড়ায় গেলে এ নোনা বা কাটা ইলিশ পাওয়া যেত। বাজারে এখন সারা বছর ধরে মাছ, মাংস সংরক্ষণে কম মূল্য বিভিন্ন মডেলের ফ্রিজ পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া জেলার দূর্গম চরাঞ্চলেও এখন বিদ্যুতের ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় ইলিশ মাছে লবন দিয়ে তেমন কেউ প্রক্রিয়াজাত করে না। জেলেরা আড়তদার ও মহাজনদের দাদনের জালে আটকে থাকায় ভাগে পাওয়া ইলিশ বিক্রি করে দেয়। ফলে জেলেরা বাড়িতে বেশি পরিমানে ইলিশ নিতে না পাড়ায় তারা এখন আর কাটা বা নোনা ইলিশ তৈরি করে না। মাদ্রাজ মাছ ঘাটের জেলে কামরুল ইসলাম বলেন, ভাগের ইলিশ মাছ বিক্রি করে ফেলি। বর্তমানে তেমন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছেনা আর যা পাই তা জাটকা হওয়ায় নুন (লবণ) দেয়া হয় না। দুলারহাট বাজারের ইলিশ ব্যবসায়ী জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সঠিক সময়ে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়না।
শিত মৌসুমের শুরুতে আমরা বড় ইলিশ পাচ্ছি না যার ফলে ছোট ইলিশ দিয়ে কাটা বা নোনা ইলিশ তৈরি করা হয় না। ক্রেতা মো. ফারুক বলেন, দীর্ঘ পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের এলাকায় কাটা ইলিশ বা নোনা ইলিশ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। জাহানপুর ইউনিয়নের জেলে ইউসুফ মাঝি বলেন, জেলেরা তাদের পেশা বদল করার চেষ্টা করছে। বছরের বেশিরভাগ সময় নদী ও সাগরের আবহাওয়া খারাপ থাকে এবং বছরের বিশেষ কিছু সময় ছাড়া তেমন ইলিশ পাওয়া যায়না। যখন ইলিশ পাওয়া যায় তখন প্রচুর দাম থাকে যার কারণে বেশিরভাগ জেলে ইলিশ মাছ বিক্রি করে দেয়ায় কাটা বা নোনা ইলিশ হারাচ্ছে তার নিজস্ব ঐতিহ্য।
মেরিন ফিসারিজ অফিসার সাইদুর রহমান বলেন, এক সময়ে জেলেরা অপ্রতিরোধ্য ভাবে ইলিশ শিকার করেছে। ক্রেতারাও কম মূল্য প্রচুর পরিমানে ইলিশ ক্রয় করতেন। তখনকার সময়ে গ্রামাঞ্চলে ইলিশ সংরক্ষণে ফ্রিজ না থাকায় তখন মানুষ ইলিশ মাছ লবন দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রাখত। বর্তমানে উপকূলীয় ও দ্বীপাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে বিদ্যুতায়ন হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে বরফ মিল তৈরি হয়েছে এবং বেশিরভাগ মানুষ এখন ফ্রিজারেটর ব্যবহার করে খাবারের মাছ মাংস দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করে ক্রয় বিক্রয় করছে। এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীতে ইলিশের অভয়ারণ্য নষ্ট হচ্ছে এবং মাছেরও প্রজনন অনেকটা হ্রাস পাওয়ায় নদীতে ইলিশের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। আর বাজারেও ইলিশের প্রচুর চাহিদা ও বেশি দাম থাকার কারণে জেলেরা যা ইলিশ পাচ্ছে তাই বিক্রি করে দিচ্ছে। আর তাই এখন আর ঐতিহ্যবাহী কাটা ইলিশের প্রক্রিয়াজাত তেমন কেউ করেনা। জেলেরা যদি সরকারের নির্দেশনা মেনে চলে তাহলে ইলিশের পুরনো ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে বলেও মনে করেন এ কর্মকর্তা।