শোক কাটছে না শহীদ আসিফ হাসানের পরিবারের
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শাহীন গোলদার, সাতক্ষীরা
বৃদ্ধ পিতা ও সৎ মাকে কথা দিয়েছিলেন মিছিলে যাবেন না, কিন্তু বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে মাটিতে লুটিয়ে পড়া এক সহকর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান সাতক্ষীরার মেধাবী ছাত্র আসিফ হাসান। ফেসবুক পোস্টে ছবি দেখে আসিফের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন তার পরিবার। দুই মাস ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও মা হারা সন্তানের অকাল মৃত্যুতে এখনো শোকে স্তব্ধ গোটা পরিবার। ছোট বেলা থেকে কোলে পিঠে মানুষ করা সৎ মা শিরীন সুলতানা এখনো মনে করেন তার সন্তান বেঁচে আছে। সে যে মারা গেছে এটা তিনি কোন ভাবেই যেন মানতে পারছেন না। এখনো বৃদ্ধ পিতা মাহমুদ আলম ও তার সৎ মা পথ চেয়ে বসে থাকেন তাদের সন্তান আবারো ফিরে আসবেন।
জানা যায়, সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে দেবহাটা উপজেলার আস্কারপুর গ্রামের মাহমুদ আলমের ৫ সন্তানের মধ্যে সবারই ছোট জমজ দুই সন্তান আসিফ হাসান ও রাকিব হাসান। তার বড় বোন মাকসুদা আক্তার মুন্নি, মেজ বোন মুন নাহার পারভীন ও ছোট বোন জেসমিন নাহার। বোনেরা সবাই বিবাহিতা। বিগত ১১ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আসিফের মায়ের মৃত্যু হয়। ছোট বেলা থেকেই সৎ মায়ের সংসারে আদর যত্নে বেড়ে ওঠে আসিফসহ তার ভাই বোনেরা। কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা আহছানিয়া রেসিডেন্টসিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন আসিফ হাসান। এরপর ঢাকায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়টির উত্তরা ক্যাম্পাসে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত ছিল আসিফ হাসান। সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদে আসিফ বাড়িতে এসেছিল। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহর যখন উত্তাল হয়ে ওঠে তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আসিফের পরিবার। গত ১৮ জুলাই বেলা ১২ বাজার এক মিনিট আগে আসিফের সাথে তার মেঝ বোন ঢাকার খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মুন নাহার পারভীনের সাথে মোবাইল ফোনে কথোপকথন হয়।
তার বোন তার কাছে শুনতে চায় ভাই তুমি কোথায় আছো? অনেক গোলা গুলির শব্দ হচ্ছে। আসিফ তখন তার বোনকে বলেন, আপা আমি মিছিলের শেষের দিকে আছি আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি নিরাপদে আছি। ফাঁকা গুলি ছুড়ছে আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। বোন মুন নাহার এসময় তাকে বলেন, তুমি মিছিল ও আন্দোলন থেকে পিছন দিক থেকে চলে যাও। আর সেখানে না থাকার জন্য তিনি তার কাছে অনুরোধ করেন। এরই মধ্যে আসিফ তার বোনকে জানান, আপা তুমি পরে ফোন করো। আমাদের এক ভাই গুলি বিদ্ধ হয়েছে। সে পানি খেতে চাচ্ছে। তাকে পানি খাওয়াতে হবে। এই বলে আসিফ তার আশেপাশের সহযোদ্ধাদের ডাক দিয়ে গুলিবিদ্ধ বড় ভাইকে পানি খাওয়ানো ও তাকে সেখান থেকে সরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং তার বোনের সঙ্গে এটাই তার শেষ কথা।
এদিকে তার বোন তাকে মোবাইল ফোনে হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছেন। ১ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড আসিফ তার বোনের সঙ্গে কথা বলেন বলে তার বোন জানান। এরপর তার বোন তাকে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি আর ফোন ধরেননি। গুলিবিদ্ধ বড় ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। গুলিবিদ্ধ আসিফ হাসানকে তার সহযোদ্ধারা পরে কুয়েত বাংলাদেশ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে জানানো আসিফ মারা গেছেন। মেজু বোন মুন নাহার আরো জানান, আসিফ মারা যাওয়ার ১২/১৪ আগেও তার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কয়েক দিন ছিলেন। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটিতে চলে যান। তিনি জানান, সাটডাউনের মধ্যে গত ১৭ জুলাই বুধবারও তিনি তাকে বলেছিলেন তার বাসায় যাওয়ার জন্য। আসিফ তার বোনকে বলেন, গাড়ি ঘোড়া সব তো বন্ধ তাহলে কিভাবে যাবেন। তার বোন এ সময় তার এলাকা থেকে তাকে আনার জন্য পরিচিত কোন বাইক পাঠানোর জন্য তাকে প্রস্তাব দেন এতে আসিফ সম্মতি দেননি। তিনি এ সময় আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন, মহান আল্লাহপাক ওখানে তার মৃত্যু লিখেছেন। এ জন্য সে সেখানে মারা গেছে। শহীদ আসিফ হাসানের সৎ মা শিরীন সুলতানা জানান, অনেক ছোট বেলা থেকেই আমি আসিফ ও রাকিবকে মানুষ করেছি। আমার মনেই হচ্ছে না আমার আসিফ নেই। মনে হচ্ছে আমার আসিফ আবার আমার কাছে আসবে। আসিফের ছোট ভাই সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রকিব হাসান জানান, ছোট বেলা থেকেই আমাদের দুই জমজ ভাইয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যা করতাম দুই ভাই পরামর্শ করেই করতাম। কোটা আন্দোলন শুরু থেকেই তার সাথে আমার প্রতিদিনই কথা হতো। ১৬ জুলাই থেকে সে প্রথম আন্দোলনে যায়। এরপর ১৮ জুলাই সে আন্দোলনে যাওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার তার মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে ফোন করে আসিফের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। ওই দিন রাতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আসিফের লাশ বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। পরদিন জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চির নিদ্রায় তাকে শায়িত করা হয়।
তিনি আরো বলেন, আমার ভাইয়ের সাথে আমার সব সময় কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে কথা হতো। আমিও কোটা আন্দোলন নিয়ে সাতক্ষীরায় অনেক মিছিল ও সমাবেশ করেছি। আন্দোলন সংগ্রামে আমার ভাই আমাকে সবসময় সাবধানে থাকার জন্য অনুরোধ করতো। মারা যাওয়ার আগের দিনও সে আমাকে বলে আমি একটু ভয়ে ভয়ে আছি, কারণ বিভিন্ন মেসে মেসে অভিযান চলছে। কখন যে আমাকে ধরে ফেলে?
ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি এসময় বলেন, কি বলবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শহীদ আসিফের বাবা মাহমুদ আলম জানান, আমি দুই থেকে তিন দিন পর পর আসিফকে ফোন করে ওর খোঁজ খবর নিতাম। আমি ওকে বাড়িতে চলে আসতে বলেছিলাম। ও বললো আব্বা আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আমি আন্দোলনে যাচ্ছি না। কিন্তু বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে পরে কখন যে সে আন্দোলনে গেলো তা আমি জানি না। আমি ভাবতেই পারছি না আমার আসিফ নেই। তার বড় ইচ্ছা ছিল ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সে দেশের বাইরে যাবে। কিন্তু কি যে হয়ে গেলো তা আমি আর বলতে পারছি না। বাকরুদ্ধ আসিফের বাবা এ সময় বলেন, আমি আমার সন্তান হারানোর এই বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ পাকই বিচার করবেন।