জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দ্বীপ জেলা ভোলার উপকূলীয় চরাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানি পাওয়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছ। আর এ সুপেয় পানি সঙ্কটকে কেন্দ্র করে এখানকার মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে আক্রান্তের তালিকায় নারীদের সংখ্যাই বেশি। নদী মাতৃক জেলা হওয়ায় প্রতি বছর লবণাক্ততার কারণে ফসলের উৎপাদন কমছে, বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে যাচ্ছে বহু লোকালয়, জনপদ। ফলে এখানকার বিপন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার সঙ্গে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ঝুঁকিও বাড়ছে। বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রকট আকার ধারণ করছে। জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট বড় অর্ধশতাধিক চর রয়েছে।
চাষাবাদ ও মৎস্য আহরণসহ জীবিকার তাগিদে এ সব চরে কয়েক লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত বসবাস করছে। এর মধ্যে সাগর মোহনার অবস্থিত উপকূলীয় জনপদ মনপুরা ও চরফ্যাশন উপজেলা। এখানে জনবসতিপূর্ণ, চর নিজাম, কলাতলির চর, কাজির চর, চর ফকিরা, ঢালচর, চর লিউলিন, চর কুকরি মুকরি, চর পাতিলাসহ ছোট-বড় প্রায় ২০টি চর রয়েছে। এসব চরগুলো মূল ভূ-খণ্ড থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। উপকূলীয় চর সমূহের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করছে অসংখ্য কিশোর-কিশোরী ও শ্রমজীবী নারী-পুরুষ। এসব চরাঞ্চলে অধিকাংশই শারীরিক পরিচর্যায় রয়েছে অসচেতন, এতেকরে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে অসংখ্য নারী-কিশোরীরা। তাই এদের পরিচর্যায় বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন উপকূলবাসী। এ সব চরে আমি পর্যাপ্ত মেডিকেল ও চিকিৎসার ব্যবস্থা। বিশুদ্ধ পানির জন্য পর্যাপ্ত টিউবয়েল নেই। মাইলকে মাইল হেটে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে হয়। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে এখানকার অধিকাংশ মানুষ পুকুরেরর পানি ও সাগরের নোনা পানি ব্যবহার করে। জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে এসব উপকূলের চরাঞ্চলে বসবাসকারী অসংখ্য শ্রমজীবী নারী স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়ে ভ্রান্ত ধারণায় নিজের জীবন বিপন্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কোষ্ট ট্রাষ্টের সমন্বয়করী রাশিদা বেগম বলেন, উপকূলীয় জেলা ভোলার নদী ও সাগরকূলের জনপদ ঢালচরসহ অন্যান্য সব চর এলাকার পানির লবণাক্ততা ও সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা একই মাত্রার। যার প্রভাব পড়েছে নারীর স্বাস্থ্যে। নারীরা কোমর পানিতে নেমে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা নানান মাছ ও চিংড়িপোনা সংগ্রহ করেন। চর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীরা সহজে স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পান না। সুপেয় পানির জন্য তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। নিজে লবণাক্ত পানি খেয়ে বা কম পানি খেয়ে পরিবারের অন্যদের পান করার জন্য পানি রাখেন। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগ, এমনকি গর্ভপাতের শিকার হন। জলবায়ু ফোরামের ভোলা জেলা সমন্বয়ক আবু সিদ্দিক বলেন, সমুদ্রে ডুবোচর জাগছে। মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সংসারের পুরুষটিকে আরো গভীর সমুদ্রে যেতে হয়। নিরাপত্তার কথা ভেবে কিশোরী মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে যেতে হয়। কিশোর ছেলেটিকে দিতে হয় ইটভাটায় বা অন্য কোনো কাজে। কখনো পুরো পরিবার মিলে ইটভাটায় কাজ করে জেলেদের দাদনের টাকা শোধ করতে হয়। কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনাপানিতে দাঁড়িয়ে মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হয়।
এ ঘটনাগুলো ভোলা উপকূলীয় এলাকার নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের জেলে পরিবারের নারীদের।’ ঢালচর ইউপি সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আাব্দস সালাম হাওলাদার বরেন, চরের এসব নারীদের অধিকাংশই তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের আরো একটি অভিঘাত হচ্ছে ক্রমেই তাপপ্রবাহ বেড়ে চলা। ফলে অত্যধিক তাপপ্রবাহ নারীর হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। আবার এ তাপপ্রবাহের মধ্যে রান্নাঘরে অনেকটা সময় কাটাতে হয়, যেখানে ধোঁয়া ও তাপ ছাড়াও পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে নারীরা হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া পোশাকের কারণে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীর মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি থাকে।’ এখানকার ৪০ শতাংশ নারী ও কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।