নারীদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে সেলাই মেশিন

প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আব্দুল কাফি সরকার, গাইবান্ধা

গেল করোনা মহামারিতে পোশাক কারখানার চাকরি হারান তহমিনা বেগম। ওই সময় ঢাকা থেকে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। এ সময় হতাশ হয়ে পড়েন। ঠিক তখনই স্বপ্ন দেখেন নিজেকে ফের কর্মস্থানের পাশাপাশি অন্যান্য নারীদেরও। শুরু করেন দর্জির কাজ। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন- ‘দর্জি ভিলেজ’। এখন এখানই তহমিনাসহ ভাগ্যবদল করেছে শতাধিক নারী। সম্প্রতি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার আব্দুল্লাহরপাড়ায় দেখা গেছে- উদ্যোক্তা তহমিনার ‘দর্জি ভিলেজ’ এর কর্মকাণ্ড। সেখানে আরো বেশ কিছু নারী কারিগর ও হেলপার হিসেবে কাজ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিত্র দূরীকরণ প্রকল্পের সহযোগিতায় কাজ শুরুর মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই তহমিনা প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘দর্জি ভিলেজ’ নামে একটি পোশাক তৈরির কারখানা। সাঘাটার বোনারপাড়া সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জুমারবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত আব্দুল্লাহরপাড়ায় বর্তমানে যেটি দর্জি ভিলেজ নামেই সমধিক পরিচিত। তহমিনা বেগমের এই বারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১৫০ জন নারীর। সব বয়সী মানুষের জন্য পাঞ্জাবী তৈরিতে বেশ সুনাম রয়েছে এই ভিলেজের।

আরো জানা যায়, এই দর্জি ভিলেজের উদ্যোক্তা তহমিনা বেগম এক সময়ে করোনা মহামারিতে হারান পোশাক কারখানার চাকরি। ওই সময় ঢাকা থেকে গ্রামে এসে হতাশ হয়ে পড়েন। তখনই আশার আলো দেখায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সাঘাটা। সেখানে মাসব্যাপী নেন সেলাই প্রশিক্ষণ। এ কর্মসূচির আওতায় নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পান ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। আর এই টাকা থেকে কিনেন সাধারণ পোশাক সেলাই ও ওভার লকের মেশিন। শূন্য হাতে থাকলেও দেখেন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন। এরপর পেছনে না তাকিয়ে তহমিনা বেগম বিআরবিডি’র গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের থিম ‘এক পল্লী এক পণ্য’ মডেল কারখানা গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি থেকেই নেন ২ লাখ টাকা উদ্যোক্তা ঋণ। এরপর যেনো সেলাইয়ের মেশিনের মতোই ঘুরতে থাকে তাদের ভাগ্যের চাকা।

প্রথমে আব্দুল্লারপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতির ৩০ জন নিয়ে শুরু করেন এ কারখানা। পরে দক্ষিণ আব্দুল্লারপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতি ও পশ্চিম আমদিরপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতিসহ তিনটি সমিতির মোট দেড়শ’ জন নারীদের নিয়ে ধুমছে চালাচ্ছেন এই পোশাক তৈরির ব্যবসা।

সরজমিনে দেখা যায়, এই কারখানায় কাজ করছেন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী মিম আক্তার। তিনি বলেন, এখানে দৈনিক ৬০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পেয়ে থাকি। ফলে পড়ালেখার খরচসহ নিজের আনুষঙ্গিক খরচের জন্য আর পরিবারের কাছে বলতে হয় না। গৃহিণী নাসরিন বেগম বলেন, সকালে সংসারের কাজ করি। ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাই। তারপর সবাইকে খাবার খাইয়ে এখানে সেলাইয়ের কাজ করতে আসি। এ থেকে মাসে ৮ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাই। এই উদ্যোক্তা তহমিনা বেগম বলেন, ঢাকা থেকে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন হাতে যেমন টাকা ছিলো না, তেমনি মাথার উপরও ছিল না কোনো ছাদ। তারপরও আশা ছাড়িনি। প্রশিক্ষণ শেষে এলাকার বোন-ভাবী, চাচীদের নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করি।

প্রথম প্রথম তেমন অর্ডার আসত না। আমরা সকলে খুব পরিশ্রম করতাম। আমার স্বামী, শাশুড়ি, দুই ছেলেও আমাকে খুব মোটিভেশন দিয়েছেন। তবে, আমার স্বামীর অবদান অনেক। তহমিনা বেগম আরো বলেন, শুরুতে তেমন আয় না হলেও এখন আমি কারখানার অন্য সদস্যদের পারিশ্রমিক দিয়েও মাসে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছি। তবে, এখন আমি আরও বড় পরিসরে কারখানা দিতে চাই। হাজার হাজার নারীকে স্বাবলম্বী করতে চাই।

এজন্য বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, গাইবান্ধা’র সহযোগিতা চান এই নারী উদ্যোক্তা। এ বিষয়ে সাঘাটা উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সামিউল ইসলাম বলেন, গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা বদ্ধপরিকর। তহমিনা বেগমের হাত ধরেই দর্জি ভিলেজের নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক বর্তমানে সাঘাটা উপজেলার নিভৃত এই পল্লীর নারীদের দক্ষ হাতে তৈরি পাঞ্জাবী, ফতুয়া, টি-শার্ট, টাউজারসহ বিভিন্ন পোশাক গাইবান্ধার গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায়।