উলের কম্বলে স্বাবলম্বী ৫০ গ্রামের মানুষ

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আজাহার আলী, বগুড়া

বগুড়ায় শীত বাড়ায় কদর বেড়েছে তাঁত শিল্পের। তাঁত শিল্পগুলো উলের কম্বল তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাঁতিরা। অন্যান্য সময় অলস সময় কাটালেও শীতের সময় দিনরাত উলের কম্বল তৈরি করতে দেখা যায়। এ কম্বলগুলো বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শাওইল গ্রামের উলের কম্বলের হাটে জমজমাটভাবে বেচাকেনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে শাওইলসহ তার আশে পাশের তাঁত শিল্প। উত্তরবঙ্গেও এই তাঁতি গোষ্ঠী আজও ধরে রেখেছে তাঁত সংস্কৃতি। গ্রামের নাম শাওইল। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম। এই গ্রামে অনেক আগে থেকেই তাঁতি শ্রণির মানুষের বসবাস। আর তার ফলে শাওইল গ্রামে তখন থেকেই এক ভিন্নধর্মী হাট গড়ে ওঠে। যার মূল শীতের চাদর কম্বল উলের (উলেন) সুতা কেনাবেচা। পর্যায় ক্রমে এই হাটের প্রাচীনতা আর জনপ্রিয়তার জন্য এবং চাদর কম্বল মূলত এই হাটে বেচাকেনা হয় বলে এই হাটের নাম দিয়েছে মানুষ ‘শাওইল গ্রামের উলের চাদর কম্বল হাটের গ্রাম’। প্রতি সপ্তাহে রোব ও বুধবার ভোর ৪টা থেকে শুরু হয়ে কেনাবেচা চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। তা ছাড়া এই হাট বসে প্রতিদিনই। এই হাটকে ঘিরে এলাকায় প্রায় ৫০টি গ্রামে গড়ে উঠেছে তাঁতি পল্লি। তারাই কম্বলকেন্দ্রিক এ শিল্পের এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যখন শাওইলের হাট বসে তখন মনে হয় যেন মেলা বসেছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীদের পদচারণায় সবসময় মুখরিত গ্রামের পথঘাট। এই হাটকে ঘিরে চলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের চাদর কম্বল আর সুতা কেনার প্রতিযোগিতা। হাটের চার পাশে ঘিরে শত শত ট্রাক, বেবিট্যাক্সি, রিকশা-ভ্যান এর উপস্থিতি। তাঁতের খটখট শব্দে আর সুতার বুননে মিশে আছে শাওইলসহ আশে পাশের গ্রামের মানুষের স্বপ্ন।

কারো রয়েছে নিজের তাঁত আবার কেউ শ্রম দিচ্ছে অন্যের তাঁতে। প্রযুক্তি দাপট তারপরেও এই আদি শিল্প শাওইল গ্রামসহ আশে পাশের গ্রামের মানুষের আঁকড়ে ধরে আছে। গ্রাম জুড়ে একটানা তাঁতের খটখট শব্দে মুখরিত গ্রামের পরিবেশ আর নারী-পুরুষসহ নানা পেশার মানুষের কর্মব্যস্ততা। কেউ সুতা ছাড়াচ্ছে আবার কেউ বা চরকা নিয়ে বসে সুতা নলি বা সূচিতে ওঠাচ্ছে কেউ বা সুতা ববিন করছে। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ও ঘরে বসানো পরিপাটি তাঁত যন্ত্র দিন রাত চলছে। কোনটা চাকাওয়ালা আবার কোনটা একেবারেই বাঁশ কাঠ দিয়ে হাতের তৈরি। শাওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, দেলুঞ্জসহ আশে পাশের প্রায় ৫০ গ্রামের চিত্র একই ধরনের। শাওইল গ্রামের চারপাশে তাঁতিদের অধিকাংশ মানুষের মূল পেশায় তাঁত শিল্পকে ঘিরে। আশে পাশের ৫০ গ্রামে ১০ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার আছে আর এ শিল্পকে ঘিরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলে। কেউ বংশ পরম্পরায় আবার কেউবা নতুন করে। শীত শুরুর আগেই শাওইলসহ আশেপাশের তাঁতিরা শুরু করে কম্বল তৈরি, সুতা বোনা ও সুতার তৈরি বড় চাদর কম্বল, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে লেডিস চাদর, কম্বল, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালাসহ নানা ধরনের শীত বস্ত্র ও পোষাক।শাওইল বাজারের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, জুয়েল আহম্মেদ, মোফাজ্জল হোসেন, শাহজাহান, জাহিদসহ অনেকেই জানান-শাওইল হাটে শুরুতে পাঁচটি দোকান থাকলেও এখন শাওইলের দোকান রয়েছে ছোট বড় মিলে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার দোকান। আর তৈরি হয়েছে নতুন নতুন আধুনিক কারিগর। খুব উন্নত মানের চাদর হওয়ায় এই চাদরের চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক। এ ছাড়া এই চাদরগুলোর মান উন্নত হওয়ায় দেশের বাহিরেও যায়। বিভিন্ন গার্মেন্টসের সোয়েটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় কম্বল, চাদরসহ আনুষাঙ্গিক পণ্য। কোন ধরনের প্রচার ও সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল এই কর্মক্ষেত্র।

চাদর তৈরির পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে শীত বস্ত্র তৈরির মেশিন, সুতা, রং, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও লাটায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাজারের আশে পাশে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক দোকান। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত লট থেকে সুতা বাছাই, ফেটি তৈরি কিংবা সুতা সাজিয়ে রাখে। দিনে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরিতে নিয়োজিত এসব কর্মচারীর অধিকাংশ আশে পাশের গ্রামের দরিদ্র মহিলা। শাওইলের চাদর আর কম্বল এর গ্রামকে ঘিরে হাজারো সম্ভাবনা থাকলেও তা সম্ভাবনার খাত হিসাবে কেউ দেখছে না। তাঁতিদের মাঝে সরকারি সুবিধা বাড়াতে পারলে গ্রামটি হতো একটি দৃষ্টান্তমূলক রপ্তানির ক্ষেত্র। তাঁত শিল্পীদের পর্যাপ্ত মূলধনের জোগান, সুষ্ঠুভাবে বাজারজাত করণের সুযোগ এবং ঠিক মতো কাঁচামাল সরবরাহ করলে এখনো আগের মত জনপ্রিয় আর গৌরবময় করে তোলা যায় এদেশের তাঁতশিল্পকে। এদেশের শিল্প সৌন্দর্যের এ ধারাকে বাঁচানো যায় ধ্বংসের হাত থেকে। প্রয়োজন কেবল একটু উদ্যোগ। আর তা পেলেই বেঁচে থাকে এদেশের তাঁতশিল্প।